Sunday, May 10, 2020

হিন্দু সংহতির লক্ষ্য কি? (৩)


মানুষের জীবনের সমস্ত কর্মোদ্যম সাধারণতঃ দুটো বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে থাকে- কাম এবং অর্থ। মানুষ যে দিন জন্মগ্রহণ করে সেই দিন থেকেই তার কিছু কিছু চাহিদারও জন্ম হয় জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম চাহিদা পূরণের সাথে সাথে সে জীবনে সুখ চায়, সমৃদ্ধি চায়, নাম-যশ চায় এবং এই সমস্ত কিছুর স্থায়িত্ব চায়। তাই সে ভবিষ্যতের জন্য রসদ সঞ্চয় করে রাখতে চায়। কিন্তু মানুষের এই চাহিদার কোনও সীমা থাকে না। চাহিদার সীমা কালক্রমে Sky is the limit হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের এই চাহিদা আবার একমুখী নয়, দশ ইন্দ্রিয় এবং মনকে পরিতৃপ্ত করার জন্য তার এই চাহিদা হয়ে ওঠে বহুমুখী। মানুষের এই বহুমুখী এবং সীমাহীন চাহিদার পরিপূরণের আকাঙ্খাকে বা সেই চাহিদা পরিপূরণের সংকল্পকেই আমাদের শাস্ত্রে কামহয়েছে।

এখন এই চাহিদা পরিপূরণের জন্য মানুষকে হয় সরাসরি সেই প্রয়োজনীয় বস্তু উৎপাদন করতে হয় অথবা বিকল্প বস্তু উৎপাদন করে তার বিনিময়ে সেই বস্তু সংগ্রহ করতে হয় অথবা অন্য কোনও উপায়ে সেই বস্তুর উপযুক্ত বিনিময় মূল্য উপার্জন করতে হয়। মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য যা কিছু উৎপাদন অথবা উপার্জন করতে হয় তাকেই বলা হয় অর্থ।

অপ্রাপ্ত বস্তুকে করায়ত্ত করার সংকল্প এবং তা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনায় অর্থ উৎপাদন- একে কেন্দ্র করেই তো আবর্তিত হয় মানুষের জীবনযাত্রা! এই দুটো জিনিষ বাদ দিলে মানুষের জীবন অচল। যে যত বেশী অর্থ উৎপাদন করতে পারে এবং তার বিনিময়ে তার চাহিদা পূরণ করতে পারে, তার জীবন তত বেশী সুখী এবং সমৃদ্ধশালী হয়। এই সুখী এবং সমৃদ্ধশালী জীবনই সফল জীবন। যার জীবনের প্রাথমিক চাহিদা পূরণ হয় না সে সুখী তো নয়ই, তার বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং জীবনকে সফল করতে হলে পর্যাপ্ত অর্থ উৎপাদন করতে হবে এবং সেই অর্থের বিনিময়ে সুখ ও সমৃদ্ধিকে সুনিশ্চিত করতে হবে। সুতরাং অর্থ আর কামের সাধনাই সাধারণ মানুষের অন্যতম সাধনা।

কাম মোটেই নিষিদ্ধ অথবা খারাপ জিনিষ নয়। কাম হল সম্পূর্ণরূপে একটা প্রাকৃতিক বিষয়। মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই কাম। সনাতনী শাস্ত্রে মানুষের জীবনের চারটে স্তম্ভস্বরূপ চার পুরুষার্থের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বলা হয়েছে এই কামকে। কাম হল প্রকৃতি। একে অস্বীকার করা অসম্ভব। কিন্তু Ecological Balance বজায় রাখার জন্য কামকে নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। কারণ মানুষের কামনা যখন সীমাহীন হয়ে যায় তখন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। শুরু হয় শোষণ। নিজের সুখের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের নেশায় মানুষ প্রকৃতিকে শোষণ করতে শুরু করে, মানুষ মানুষকে শোষণ করতে শুরু করে। প্রকৃতির সমস্ত সম্পদকে নিজের করায়ত্ত করার জন্য শুরু হয় প্রতিযোগিতা, শুরু হয় লড়াই। কিন্তু এই লড়াই সৃষ্টির মূল সুরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই লড়াই সৃষ্টির সমন্বয়ের নিয়মের পরিপন্থী। এই লড়াইয়ে শেষমেষ Ecological Balance নষ্ট হয়, যার পরিণতি হচ্ছে সমূহ বিনাশ।

অর্থ আর কামের জন্য প্রতিযোগিতা বা লড়াই নয়, একে সাধনায় রূপান্তরিত করাই সনাতনী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। সেইজন্য চার পুরুষার্থের মধ্যে অর্থ এবং কামের আগে ধর্ম এবং পরে মোক্ষের কথা বলা হয়েছে। ধর্ম শব্দটি এসেছে ধৃ ধাতু থেকে। ধৃ মানে যা ধারণ করে রাখে। যে আচরণবিধি সৃষ্টির Ecological Balance কে ধরে রাখে তাই সনাতন ধর্ম। তাই ধর্মের পথে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা, ধর্মের পথে উপার্জিত অর্থকে ব্যবহার করা এবং ধর্মানুসারে কামের পরিপূরণ করাই অর্থ আর কামের যথার্থ সাধনা।

মোক্ষ হল নিজের স্বরূপকে উপলব্ধি করা। নিজেকে জানতে পারলেই এই জীবনচক্র থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এই শরীরের মৃত্যু হল একটা চরম সত্য। কিন্তু মৃত্যুর পরে কি? সূক্ষ্ম উপলব্ধির কথা না হয় বাদই দিলাম, কারণ নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করা অনেক সাধনার ফলেই সম্ভব হয়, স্থুল দৃষ্টিতেও যদি দেখা যায় তাহলে প্রশ্ন ওঠে- এই শরীরের পতনের পরে আমি আমার সঞ্চিত অর্থের কতটা সাথে নিয়ে যেতে পারবো? যদি ভাবি আমার অর্জিত সম্পদ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাবো, সেটাও কতটা যুক্তিযুক্ত? এই প্রসঙ্গে একবার একজন মজা করে বলেছিলেন- সন্তান যদি অপদার্থ হয় তাহলে তার জন্য আমার সঞ্চিত অর্থ রেখে লাভ কি? সে তা তার অপব্যবহার করে শেষে নিঃস্ব হয়ে যাবে! আর যদি আমার সন্তান যোগ্য হয় তাহলে তার জন্য সম্পদ রেখে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাই বা কি? সে তো নিজের যোগ্যতাতেই তার জীবনকে সফল করবে!

এই ধর্মের বোধ আর মোক্ষের চিন্তাই অর্থ আর কামকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মানুষের জীবনকে যদি একটা নদীর সাথে তুলনা করা যায় তাহলে সেই নদীখাতে প্রবাহিত উদ্দাম জলরাশি হল অর্থ আর কাম, যা হল জীবনের মূল চালিকাশক্তি। নদীর দুই পাড় হল ধর্ম, যা সেই প্রবাহের নিয়ন্ত্রক। আর মোক্ষ হল নদীর অন্তিম লক্ষ্য সেই মহাসাগর, যা নদীর প্রবাহের গন্তব্যকে সুনিশ্চিত করে সঠিক দিকনির্দেশ করে দেয়। জলই নদীর জীবন। যে নদীর জল যত বেগবান, সেই নদী ততই জীবন্ত এবং প্রকৃতির পোষক। জল শুকিয়ে যাওয়া মানে নদীর মৃত্যু। ঠিক সেইভাবেই, যে ব্যক্তির অর্থ আর কামের সাধনায় প্রেরণা নেই, সে জীবন্মৃত। সে নিজের জীবনে ব্যর্থ তো বটেই, সে অন্যেরও কোনও কাজে লাগে না। আবার নদীর জল যদি দুই পাড়কে ছাপিয়ে যায়, তাহলে সেই বন্যায় নদী নিজেও দিকভ্রষ্ট হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, সাথে সাথে সকলের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিও করে। সেই রকমই অর্থ আর কামের এই প্রবাহ ততক্ষণই সকলের জন্য আশীর্বাদ, যতক্ষণ তা ধর্মের সীমা অতিক্রম না করে এবং লক্ষ্যচ্যূত না হয়।

সনাতনী বঙ্গবাসীকে যদি মাথা তুলে দাঁড়াতে হয় তাহলে আজ আমাদের অর্থ আর কামের সাধনায় রত হতে হবে। প্রচুর অর্থ উৎপাদন করতে হবে। ধর্মানুযায়ী সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন করতে হবে। ধর্মানুযায়ী অর্থ সঞ্চয় করতে হবে এবং অতিরিক্ত অর্থ সমাজকল্যাণে দান করতে হবে। এই সাধনায় আমাদের জীবন শুধুমাত্র সফলই হবে না, আমাদের জীবন সার্থক হবে।

এই বঙ্গভূমির সন্তানরা কৃষি, ব্যবসা, কারীগরি বিদ্যা- কোনও বিষয়েই পিছিয়ে থাকে নি। ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাসে আমরা পাই মোটামুটি খ্রিষ্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত কিছুটা উন্নত ধরনের চাষবাস এবং গৃহশিল্প ধন-উৎপাদনের বড়ো উপায় হলেও, প্রধানতম উপায় ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য।’ ‘অন্যান্য শিল্পের মতো নৌ-শিল্পেও বাংলার একটা স্থান ছিল। সাধারণ লোকের যাতায়াত এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও নৌবহরের ওপর সামরিক শক্তি রীতিমত নির্ভর করত। বিভিন্ন লিপিতে নৌকার ঘাট এবং জাহাজঘাটার উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব থেকে নদীগামী ছোট বড়ো নৌকা এবং সমুদ্রগামী পোত ইত্যাদি নির্মাণ-সংক্রান্ত শিল্প ও ব্যবসার কথা সহজেই আঁচ করা যায়।’ ‘প্রাচীন বাংলায় শুধু যে দেশের ভেতরে ব্যবসা-বাণিজ্য হত তা নয়, বিদেশের হাটে-বাজারেও জিনিষপত্র রপ্তানি হত। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে দেখা যায়, বাঙালি বণিকেরা দক্ষিণ-ভারতের সমুদ্রপোকূল ধরে গুজরাট পর্যন্ত যেসব বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে যেতেন, তার মধ্যে ছিল পান, সুপারি, নারকোল। সুপারির বদলে মাণিক্য, পানের বদলে মরকত এবং নারকোলের বদলে তাঁরা শঙ্খ আনতেন। বাঙালি বণিকরা সামুদ্রিক লবণের বিনিময়ে পাথুরে লবণ নিয়ে আসতেন। লবণের ব্যবসাতে যে প্রচুর লাভ হত, পরে লবণের ব্যবসা নিয়ে কাড়াকাড়ি থেকেই তা বোঝা যায়। স্থলপথের চেয়ে বাংলাদেশে নৌ-বাণিজ্যই প্রধান ও প্রশস্ততর ছিল। সেই কারণেই বাংলার প্রাচীন লিপি ও সাহিত্যে নৌকোর ঘাট এবং নদ-নদী-নৌকোর স্মৃতি এত প্রবল। সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রধান বন্দর ছিল গঙ্গাবন্দর ও তাম্রলিপ্তি। চতুর্থ শতকে সিংহলের সঙ্গে তাম্রলিপ্তির বাণিজ্যপথের আভাস পাওয়া যায়। তারও তিন-চারশো বছর আগে ভারতের দক্ষিণ-সমুদ্রতীর ধরে গঙ্গাবন্দর ও তাম্রলিপ্তির সঙ্গে সুদূর রোম সাম্রাজ্যেরও বাণিজ্য-সম্বন্ধের আভাস পাওয়া যায়।
সাহিত্যিক শংকর তাঁর বিজনেসে বাঙালিপ্রবন্ধে বাঙালি ব্যবসায়ীদের রমরমা অবস্থা সম্পর্কে বলছেন- রাজা বল্লাল সেনের সময় বল্লভানন্দ আঢ্য নামে এক বনিকের সংগ্রহে ছিল ১৮ কোটি স্বর্ণমুদ্রা। অষ্টাদশ শতাব্দীর নিমাইচরণ মল্লিকের কলকাতায় অন্তত ৯৬ খানা বাড়ি ছিল। বড়বাজারে তার প্রাসাদ সদৃশ বাড়ির একধার থেকে আরেকধারে যেতে পালকি ব্যবহার করত বাড়ির মেয়েরা, এতটাই বড় ছিল সেই বাড়ি। শোভারাম বসাকের বাড়ি ছিল ৩৭ টা। ব্যাংকিং শিল্পে বাঙালির বিপুল অবদানের কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ছেঁড়াকাঁথা থেকে ঐশ্বর্যলক্ষীর বরপুত্র হওয়া রামদুলাল দে-র কথা। যার জীবনকাহিনীর সাথে মিল পাওয়া যায় রিলায়েন্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বানির। একই সাথে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বৈষ্ণবদাস শেঠ, লক্ষ্মীকান্ত ধর, গোবিনচাঁদ ধর, কৃষ্ণদাস মল্লিক প্রমুখের কথা। জানিয়েছেন এদেশে ইনসিওরেন্স ব্যবসার সূত্রপাত করেন হীরালাল শীল। কানাকড়ি হীন অবস্থা থেকে একজীবনেই অসম্ভব বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন মতিলাল শীল। সম্পত্তির বহর দেখলে মনে হবে আধখানা কলকাতাটাই মতিলাল শীলের।
এই ইতিহাসের খতিয়ান অনেক লম্বা। যারা এই নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী, তারা আমাদের জানাবেন বিস্তারিতভাবে আমাদের এই গৌরবময় ইতিহাসের কথা। আমাদের কাজ শুধুমাত্র ইতিহাস চর্চায় সীমাবদ্ধ রাখলেই হবে না। হিন্দু সংহতিকে সনাতনী বঙ্গবাসীর পুনরুত্থানের এই সাধনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।  

Sunday, May 3, 2020

হিন্দু সংহতির লক্ষ্য কি? (২)

আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, আমাদের এই পুণ্য বঙ্গভূমি এবং এই ভূমিতে জন্ম নেওয়া সনাতন জীবনদর্শনকে রক্ষা করাই হিন্দু সংহতির কাজ। কারণ এই সনাতন জীবনদর্শন মানব কল্যাণকারী। এই জীবনদর্শনই সমগ্র সৃষ্টিকে বিনাশের হাত থেকে বাঁচাতে পারে।

সনাতনী জীবনদর্শনের আধার হল এই মাটি এবং এই মাটির সন্তানদের নিয়ে গঠিত সমাজ। এই মাটিতে আমরা জন্ম নিয়েছি। এই মাটির কোলেই আমরা লালিত পালিত হয়েছি। এই ভূমির জল-বায়ু-আকাশ আমাদের পোষণ করেছে। তাই এই ভূমির সাথে আমাদের সম্পর্ক জীবন্ত এবং অবিচ্ছেদ্য। কৃতজ্ঞতা বোধ এবং শ্রদ্ধাবোধ থেকে আমরা এই মাটিকে মায়ের স্থানে বসিয়েছি। দশপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গারূপে তাঁর পূজা করেছি বন্দেমাতরম মন্ত্রে।    

আমাদের পূর্বপুরুষদের কঠোর সাধনায় যে জীবনধারার ক্রমবিকাশ এই মাটির উপরে হয়েছিল, আমরা এই বঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে গেলে আজও সেই সনাতনী জীবনদর্শনের ফলিত রূপ দেখতে পাই। ঘুম থেকে ওঠার পরে মাটিতে পা দেওয়ার আগে মাটিকে প্রণাম করার অভ্যাস এখনও দেখতে পাওয়া যায়মাটিতে পা দিয়ে আঘাত করলে আজও আমাদের বাড়ির বয়স্করা বাচ্চাদের নিষেধ করে বলেন- এরকম করলে ধরিত্রী মায়ের আঘাত লাগবে। আমাদের বাড়ির মায়েরা আজও অম্বুবাচী পালন করেন কারণ তাদের বিশ্বাস- ওই নির্দিষ্ট সময়ে ধরিত্রী মাতা রজঃশলা হন। বাড়িতে বাড়িতে তুলসী গাছকে শ্রদ্ধা সহকারে প্রণাম করা আজও আমাদের পরম্পরাআধুনিক বিজ্ঞান গাছের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণ করার অনেক যুগ আগে থেকেই আমাদের গ্রামের নিরক্ষর বুড়ি মায়েরা তাদের নাতি-নাতনীদের সহজ ভাষায় শিক্ষা দিয়ে এসেছেন যে রাতে গাছের পাতা অথবা ফুল ছিড়তে নেই কারণ রাতে গাছেরাও আমাদের মত ঘুমায়আমাদের দেশে গাছ মরে যায়! কে মরে যেতে পারে? সে ই মরতে পারে যে জীবিত আছে! এর অর্থ হল উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে তার উপলব্ধি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের বহুকাল আগে থেকেই ছিল। গাছের সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপন, জলাশয় খনন- বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না জানলেও ধর্ম হিসেবে গ্রামবাংলার তথাকথিত অশিক্ষিত সনাতনীরা এগুলো পালন করতে অভ্যস্ত আছেনআধুনিক বিজ্ঞান যখন থেকে জড় (Mass) আর চৈতন্য (Energy)-র পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে, তার অনেক আগে থেকেই তথাকথিত অশিক্ষিত সনাতনীরা জানে যে জড়বস্তুর মধ্যেও চৈতন্যের অস্তিত্ব আছে। আজও ট্রেনে অথবা বাসে চড়ে কোনও নদী পার হওয়ার সময় কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করতে দেখা যায় অনেককেই। এই অভ্যাস মোটেই মোদীজীর নমামি গঙ্গে প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে শুরু হয় নি। মানুষের জীবনে নদীর অবদানের কথা স্মরণ করে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার সনাতনী জীবনদর্শনেরই চিরন্তন শিক্ষা। এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে ধারাবাহিকভাবে সঞ্চারিত হতে হতে এই বিশিষ্ট্য জীবনধারা অনুযায়ী আচরণ আমাদের সহজাত প্রবৃত্তিতে পরিণত হয়েছিল। এই ভাবেই গড়ে উঠেছিল আমাদের সংস্কৃতি।

এই প্রকৃতিরই অঙ্গ হওয়ার কারণে মানুষেরও প্রাকৃতিক চাহিদা আছে। কিন্তু মানুষের প্রাকৃতিক চাহিদা পুরণ করতে গিয়ে যাতে Eco balance যাতে নষ্ট না হয় সে কথাও ভাবা দরকার। প্রকৃতির নিয়মেই আমাদের খিদে পায়। খাদ্য গ্রহণ করলে আমাদের দেহ ও মন পরিতৃপ্ত হয়। পাশাপাশি এটাও সত্য যে আমার আপনজন কেউ অভুক্ত থাকলে সুস্বাদু খাদ্য খেয়েও মনে কষ্ট থেকে যায়। মনে করুন প্রাকৃতিক নিয়মে আমার খিদে পেয়েছে, একই কারণে আমার পরিবারের সদস্যদেরও খিদে পেয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে আমরা সবাই কি খাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করবো? না কি যেটুকু খাবার আছে সেটা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে খাবো? খিদে পাওয়া প্রকৃতি। কাড়াকাড়ি করে খাওয়াটা হল বিকৃতি। কিন্তু অপরের জন্য প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকার করে ভাগাভাগি করে খাওয়াটা হল সংস্কৃতি। আজকে কোরোনা-র জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে- নাকে মুখে রুমাল দিয়ে হাঁচুন। হাঁচির উদ্রেক হয় তো প্রাকৃতিক কারণে। এটা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এবার আপনি অন্যের মুখের উপরে হাঁচতেই পারেন। সেটা বিকৃতি হিসেবেই গণ্য হবে কিন্তু মুখে রুমাল দিয়ে হাঁচি দিলে সেটাই সংস্কৃতি। যে যত বেশী অন্যের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভেবে নিজের আচরণকে সংযত করবে, সে ততই সভ্য এবং সংস্কৃত। সনাতনী জীবনদর্শনের ভিত্তিতে আমাদের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তার মূল ভিত্তি ছিল ত্যাগ। বলা হত ত্যাজদেকং কুলস্যার্থে, গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যাজেৎ/ গ্রামং জনপদস্যার্থে, আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যাজেৎ।। অর্থাৎ পরিবারের জন্য প্রয়োজনে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করতে হবে, গ্রামের জন্য পরিবারের স্বার্থ। আবার জনপদ অর্থাৎ আরও বৃহত্তর স্বার্থে গ্রামের স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে এবং সর্বোপরি সত্যের জন্য প্রয়োজনে সবকিছুই ত্যাগ করতে হবে। এই সংস্কৃতির ধারক বাহক হিসেবে আমাদের কি গর্ব করা উচিত নয়? এই সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেলে শুধু মানবতা নয়, সমগ্র সৃষ্টিকে রক্ষা করার পথ দেখাবে কে?  

মাতৃস্বরূপা আমাদের এই ভূমি, তার সন্তানদের নিয়ে গঠিত সমাজ, সনাতনী জীবনদর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আমাদের সংস্কৃতি এবং নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের জন্য বিকশিত হওয়া আমাদের বাংলা ভাষা- এই সবের সমন্বয়ে আমাদের নিজস্ব একটা জাতিগত পরিচয় বা আইডেনটিটি তৈরি হয়েছেসেই পরিচয়ের প্রকাশক শব্দ বা নাম হল বাঙ্গালী এই নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের গৌরবময় ইতিহাস, আমাদের স্বাভিমান। এই নামই আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের শক্তি এই নামই আমাদের সমাজবোধের কেন্দ্রবিন্দু, সনাতনী বঙ্গসন্তানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের জিয়নকাঠি। বাঙ্গালী নামই আমাদের এই বঙ্গভূমির মালিকানার দলিল এই মাটির মালিকানা বজায় রাখতে হলে বাঙ্গালী পরিচয়ের মালিকানা ধরে রাখতে হবে। আর এই নামের মালিকানা দখলে রাখতে হলে আমাদের সমাজকে শক্তিশালী করতে হবে, আমাদের সংস্কৃতিকে নিজেদের আচরণে প্রতিফলিত করতে হবে এবং আমাদের ভাষাকে শুদ্ধ এবং সমৃদ্ধ করতে হবে ভালো করে লক্ষ্য করুন, আজকে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং ভাষা- এই তিনটে জিনিষই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন? এগুলোকে ধ্বংস করতে না পারলে আইডেনটিটি বা নামের দখল নেওয়া যায় না আর নামের দখল মানেই মাটির দখল।

সমাজকে দুর্বল করার জন্য ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমে প্রতিদিন আমাদের ভাইবোনদের আমাদের সনাতনী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাথে সাথেই তারা এই মাটির সনাতনী সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনদর্শন। সাথে সাথে লাভ জেহাদ, অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার ইত্যাদি বিভিন্ন কৌশলে নিজেদের জনসংখ্যা বাড়িয়ে জনভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে। সনাতনী বাঙ্গালী সমাজ হচ্ছে দুর্বল থেকে দুর্বলতর। পাশাপাশি আধুনিকতার নামে সনাতনী জীবনাদর্শের অপব্যাখ্যা করে তার প্রতি অশ্রদ্ধা তৈরি করা হচ্ছে এবং এইভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলোকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। আর বাংলা ভাষার ব্যাপক আরবীকরণের মাধ্যমে আমাদের ভাষাকেও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ যারা এই আক্রমণ চালাচ্ছে তারা কিন্তু বাঙ্গালী পরিচয়কে ছাড়ছে না। কারণ তারা জানে যে দেশের বর্তমান সিস্টেমের মধ্যে থেকে যদি এই মাটির মালিক হতে হয়, তাহলে নামের মালিক হতে হবে। আপাতত বাঙ্গালী নামের মুখোশের আড়ালে ভিতরে ভিতরে ব্যাপক হারে রদ বদলের কাজ চলছে। সব কিছুর আসল উদ্দেশ্য এই মাটির দখল। ইতিমধ্যেই এই বঙ্গের দুই তৃতীয়াংশ মাটি বেদখল হয়ে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখনও এই ষড়যন্ত্রের স্বরূপ বুঝতে না পারলে একদিন সুন্দর সকালে দেখা যাবে এই মাটির মালিকানা আসল বাঙ্গালীর হাত থেকে নকল বাঙ্গালীর হাতে চলে গেছে। তাই নামের মালিকানা দখলে রাখতে হবে আইডেনটিটি ধ্বংস হওয়া মানে জাতির বিনাশ। আইডেনটিটির সংকট মানে অস্তিত্বের সংকট। আইডেনটিটি বেদখল হয়ে যাওয়া মানে সমস্ত সম্পদ এবং অধিকার থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে, আমাদের আসল বাঙ্গালী পরিচয় কখনোই আমাদের ভারতীয় পরিচয়ের পরিপন্থী নয়। বরং এই বঙ্গ এবং বাঙ্গালী ভারতের সাথে সম্পূর্ণ একাত্ম থেকেছে, ভারতকে সমস্ত দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে, ভারতকে রক্ষা করার জন্য আত্মবলিদান দিয়েছে এমনকি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একসময় ভারতকে নেতৃত্বও দিয়েছে।   

মাটির দখল নেওয়ার জন্যই আসল বাঙ্গালীকে ধ্বংস করার এই চক্রান্ত। এই চক্রান্তের জাল অনেক বিস্তৃত এবং এর শিকড়ও অনেক গভীরে প্রোথিতভাষাকে জাতি গঠনের মূল ভিত্তি ধরে ভারতকে টুকরো টুকরো করার ষড়যন্ত্র কমিউনিস্টদের পুরোনো এজেন্ডা। গোটা বঙ্গপ্রদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এই কমিউনিস্টরা মহম্মদ আলি জিন্নার দেশভাগের দাবিকে সমর্থন করেছিলমুসলিম লীগ এবং কমিউনিস্টদের যোগসাজসে রচিত এই চক্রান্ত ১৯৪৭ সালে সম্পূর্ণ সফল না হলেও এরা হাল ছেড়ে দেয় নি। বাংলা ভাষার জিগির তুলে বাঙ্গালী আইডেনটিটি হাইজ্যাক করে বাঙ্গালীদের সনাতনী শিকড়কে ভুলিয়ে দেওয়ার যে চক্রান্ত আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা সেই পুরোনো বামৈস্লামিক এজেন্ডারই আধুনিক রূপ৩৪ বছরের বাম শাসনকালে বাঙ্গালীর মন থেকে সনাতনী ভাবধারাকে মুছে দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করা হয়েছে। বামৈস্লামিক শক্তি উপলব্ধি করেছিল পশ্চিমবঙ্গকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে গ্রেটার বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করতে হলে বাঙ্গালীকে তার সনাতনী শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। কারণ এই সনাতনী শিকড়ই আমাদের ভারতের সাথে একাত্ম করে রেখেছে। তাই ইতিহাস বিকৃত করে, ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা করে আমাদের যুবসমাজের মনে তাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে, তাদের অতীত সম্পর্কে লজ্জার ভাব তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে। বিভিন্নভাবে যুবসমাজকে বোঝানো হয়েছে যে সনাতনী জীবনধারা রিগ্রেসিভ, অচল। তাই আধুনিক হতে হলে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এসব ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করতে হবে। অদৃষ্টের পরিহাস, আজ যখন সারা বিশ্ব অনুভব করছে যে সৃষ্টির সমূহ বিনাশ রোধ করতে হলে সবাইকে সনাতনী জীবনপদ্ধতিকেই গ্রহণ করতে হবে, হ্যান্ডশেক-হাগিং ছেড়ে সবাই হাতজোড় করে সনাতনী পদ্ধতিতে নমস্কার করছে, তখন এই কমিউনিস্টদের মাইক্রোস্কোপ দিয়েও দেখা যায় না! লুপ্তপ্রায় প্রজাতির তালিকাভুক্ত হওয়ার পরেও এদের শয়তানির বিরাম নেই। কথায় আছে শয়তানেরা ঘুমায় না! বাঙ্গালীর সনাতনী পরিচয় ধ্বংস করার এই কাজে বামৈস্লামিক শক্তির ক্রীড়নক হিসেবে একটা দল বাঙ্গালী সেজে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই নকল বাঙ্গালীদের দলের নেতাদের দেখা গেছে বাংলাদেশের জামাতের নেতাদের সাথে মিটিং করতে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদেরও লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে বাঙ্গালীদের বিভ্রান্ত করার জন্য। এই পরিস্থিতিতে এই বঙ্গভূমিকে বাঁচাতে হলে বাঙ্গালীর সনাতনী শিকড়কে যেকোনও মূল্যে মজবুত করতে হবে। ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বেঁচে থাকতে হলেও বাঙ্গালীর সনাতনী শিকড়কে মজবুত করতে হবে। আসমুদ্রহিমাচল ব্যাপ্ত বৃহত্তর সনাতনী সমাজের সাথে একাত্ম হয়ে বেঁচে থাকতে হলেও বাঙ্গালীর সনাতনী শিকড়কে মজবুত করতে হবে।

শত্রুদের বিছানো ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বঙ্গভূমিকে ভারতসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই একটা বড় লড়াই। এই লড়াই ভারতকে জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসানোর লড়াই। এই লড়াই বাস্তবে মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর লড়াই, সমগ্র সৃষ্টিকে রক্ষার লড়াই। শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের প্রান্তিক বাঙ্গালীকে তার শিকড়ের পরিচয় করানোর এই কাজে ধর্মগুরুদের(অবশ্যই যাঁরা ভণ্ড নন)এগিয়ে আসতে হবে, যারা কবিগান এবং কীর্তন পরিবেশন করেন তাদেরও এই লড়াইয়ে বিশেষ ভুমিকা নিতে হবে। এই কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে শিক্ষক, ইতিহাসবিদ, বৈজ্ঞানিক, গবেষক, লেখক, কবি, গায়ক, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রকর, চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা- এই ধরণের ব্যক্তিদের। বৌদ্ধিক ক্ষেত্রের এই লড়াই খুবই গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান করছি। লড়াই হবে বিভিন্ন আঙ্গিকে। লড়তে হবে গোটা বাঙ্গালী সমাজকে। হিন্দু সংহতি এই মহাযুদ্ধে ঐতিহাসিক ভুমিকা পালন করার জন্য প্রস্তুত।