Tuesday, November 26, 2019

হিন্দু ভোট যত কনসলিডেট হবে, হিন্দু তোষণের প্রতিযোগিতা তত বাড়বে

যেদিন রামমন্দির ইস্যু প্রথমবার সকলের সামনে এসেছিলো, সেই দিনটাতেই বোধহয় ভারতের রাজনীতির হিন্দুকরণের সূত্রপাত হয়েছিল বলে ধরা যায়। হিন্দুদের কোনও দাবি নিয়ে যে রাজনীতি হতে পারে, এর আগে এটা অবাস্তব বলে মনে হত সবার। কিন্তু ভারতের রাজনীতিকে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত করে দিল এই ইস্যু। ভারতের রাজনীতিতে আগে ছিল শুধুই মুসলিম পক্ষ। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের পাখির চোখ ছিল মুসলিম ভোট। রামজন্মভূমি আন্দোলন থেকে শুরু হল হিন্দুর রাজনৈতিক কনসলিডেশন। হিন্দুরা এবার একটা পক্ষ হল। তাদের একটা আত্মবিশ্বাস জন্মালো - যে হিন্দুরা বাবরি মসজিদকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে, তাদের অসাধ্য আর কী থাকতে পারে! এই আত্মবিশ্বাস থেকেই তৈরি হল হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক আর এই ভোটব্যাঙ্ককে পাখির চোখ করল বিজেপি। বিজেপির উত্থান এই হিন্দু ভোটের উপরে ভিত্তি করেই। রামজন্মভূমি আন্দোলন‌ই বিজেপিকে ভারতের রাজনীতিতে এসকেপ্ ভেলসিটির ইন্ধন যোগালো।

যদিও ভারতের রাজনীতির গতি প্রকৃতি আগেও হিন্দুরাই নির্ধারণ করতো, কিন্তু এই বোধ হিন্দুদের এর আগে ছিল না। একটা মিথ্যা ন্যারেটিভ সুন্দর ভাবে পরিবেশন করা হত - মুসলিম ব্লকভোট‌ই ভারতের রাজনীতির ভাগ্যনিয়ন্তা। আর এই মিথ্যাকে ছন্নছাড়া হিন্দুরা বিশ্বাস করতো মনেপ্রাণে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতৃত্বের অধিকাংশ এখনও এই বিশ্বাস নিয়েই রাজনীতি করে যে মুসলিম ভোট না পেলে এরাজ্যে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়। তাদের এই ধারণার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। 

বিশ্ববাসীর ভুল ভাঙলো ২০১৪ সালের সেই দিনটাতে, যেদিন গুজরাটের গোধরায় হিন্দু হত্যার দৃষ্টান্তমূলক প্রতিশোধের নায়করূপে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হলেন। এই জয় বাস্তবে বিজেপির জয় ছিল না, এই জয় ছিল দীর্ঘদিনের পরাজয়ের গ্লানি বুকে চেপে রাখা, নিজের দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের ব্যবহার পেয় লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে থাকা হিন্দুদের বহু আকাঙ্খিত জয়। হিন্দুরা মোদিজীর অভিষেক চেয়েছিল, তাই মোদিজী সিংহাসনে বসেছিলেন। তাই আমরা দেখলাম উন্নয়নের জোয়ার ব‌ইয়ে দেওয়া স্বপ্নের নায়ক উদারচতা বাজপেয়ীজীর ফিলগুডের সরকার পরাজিত হলেও ২০১৪-তে ব্যাপক জনসমর্থন পেলো মুসলমানের রক্তে হোলি খেলার তকমাধারী নরেন্দ্র মোদির সরকার। 

২০১৪ র নির্বাচনের ফলাফল হিন্দুদের আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল এবং মোদিজীও এই পাল্স বুঝে নিয়েছিলেন সঠিকভাবেই। তাই পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, তিন তালাক নিষেধ, বারাণসীর তীরে গঙ্গারতি, সৌদি আরবে মন্দির নির্মাণ, নাগরিকত্ব বিল লোকসভায় পাশ করানো মোদি সরকার ২০১৯-এ হল আরও অনেক বেশি শক্তিশালী। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি এই সরকারকে। নিয়ে চলেছে একের পর এক কঠোর এবং সাহসী সিদ্ধান্ত - ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, রামমন্দির তৈরির পথ প্রশস্ত করার পথ ধরে আবার আসছে নাগরিকত্ব বিল এবং তারপরে এন‌আরসি। দ্বর্থ্যহীন ভাষায় সরকারের সাহসী ঘোষণা - বহিরাগত হিন্দুরা শরণার্থী আর মুসলমানরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী! দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র হতে আর বাকি র‌ইলো কী!

সরকারের এই সিদ্ধান্তগুলো হিন্দুদের প্রতি ন্যায় বিচার তো অবশ্যই, কিন্তু যদি রাজনীতির পরিভাষায় কেউ একে 'হিন্দু তোষণ' বলে, সে কি বিরাট ভুল করে ফেলবে? কেউ যদি বলে বিজেপির এই 'হিন্দু তোষণ' বিরোধী দলগুলোর মুসলিম তোষণের পাল্টা রাজনৈতিক চাল, সেও কি খুব ভুল বলবে? দেশের ৮০% ভোটারকে কনফিডেন্সে নিয়ে রাজনীতি করাটাই তো স্বাভাবিক। তবে এটা এতদিন কোনও পার্টি করেনি কেন? কারণ এতদিন হিন্দুরা তাদের ভোটের মূল্য এবং ক্ষমতা বোঝে নি। মুসলমানরা বরাবর মুসলমান হিসেবে ভোট দিয়েছে, হিন্দুরা ভোট দিয়েছে নিজের নিজের পছন্দের পার্টির একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে। সেকুলার ভারতে হিন্দু হিসেবে ভোট দেওয়া যায়, এবং সেই ভোটে সরকার গড়া যায় একথা বাবরি ধ্বংসের আগে হিন্দুরা কোনদিন ভাবতেই পারেনি। সেই ঘটনার পরে কিন্তু হিন্দুদের মনে নিজেদের দেশ নিজেরা শাসন করার একটা আকাঙ্খার জন্ম নিয়েছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। তাই এই 'হিন্দু তোষণ' অথবা হিন্দুত্ব কেন্দ্রিক রাজনীতি বর্তমান সেকুলার ভারতে সম্ভব হয়েছে কোনও রাজনৈতিক দল অথবা নেতার বদান্যতায় নয়, এটা সম্ভব হয়েছে হিন্দু তার শক্তি সম্পর্কে অবহিত হয়েছে বলে, বিশেষতঃ সে তার ভোটের মূল্য এবং ক্ষমতা - দুটোই বুঝতে পেরেছে বলে।

একদিকে হিন্দু তার ভোটের মূল্য বুঝতে পেরেছে। অপরদিকে মোদি-শাহ'র বিজেপিও হিন্দুদের ভোটের মূল্য কিছুটা হলেও দিয়েছে। প্রতিদানে হিন্দুরাও তাদের বিমুখ করে নি। পরিণামে আজ হিন্দু ব্লকভোট‌ আর বিজেপির সাপোর্ট বেস সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলস্বরূপ কোনঠাসা হয়েছে সেকুলারিজমের নামে মুসলিম তোষণকারী প্রত্যেকটা দল। চাপে পড়ে এখন অনেকের মাথা থেকে ফেজটুপি সরে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে নীলসাদা হিজাব। সম্প্রতি আমাদের রাজ্যে উদ্বাস্তুদের জন্য জমির পাট্টা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। খুব সম্ভব রাজ্য সরকারের দৃষ্টিতে হিন্দুরাই উদ্বাস্তু। যদি তা ই হয়, তাহলে কি এবার এই রাজ্যেও 'হিন্দু তোষণ' পর্ব শুরু হতে চলেছে? অসম্ভব কিছু নয়।

১৫-২০% বাম ভোটের সাথে গোটা ১৫% মুসলিম ভোট তৃণমূলের থেকে বেরিয়ে গিয়ে জোট বাঁধার যে ভয় দেখিয়ে রাজ্যের মুসলমানরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্ল্যাকমেল করছিল, বামেদের ভোট কমে গিয়ে ৭% এ ঠেকায় এখন সেটা আর করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং মমতা ব্যানার্জির মুসলিম তোষণের কম্পালশন আর বিশেষ নেই। তাই এখন ওয়েসি-র মিম পার্টিকে এনে তৃণমূলের মুসলিম ভোট কাটার ভয় দেখিয়ে মমতাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে মুসলমানেরা। কিন্তু মুসলমানরা কি তৃণমূলের ভোট কেটে বিজেপির সুবিধা করে দিতে চাইবে? তারা এটা করবে বলে আমার মনে হয় না। তাহলে নিজেদের বাঁচার তাগিদে তৃণমূলকে বাঁচিয়ে রাখার কম্পালশন এখন কাদের? মমতা ব্যানার্জি এখন মুসলমানদের কেবল বিজেপির জুজু দেখিয়েই শান্ত করে রাখবেন। আমি বিশ্বাস করি মমতা ব্যানার্জি যা করেন, নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই করেন।

এদিকে মিমের প্রচারে যে হিন্দু কনসলিডেশন তৈরি হবে, তাকে ভাঙার জন্য মমতা ব্যানার্জিকে হিন্দুর জন্য হাত খুলতেই হবে। ইতিমধ্যেই তার কিছু কিছু ইঙ্গিত‌ও পাওয়া যাচ্ছে। মাথার হিজাব তো নেমে গেছেই, সাথে সাথে পূজার ভোগ রান্না করার ভিডিও বের করা হচ্ছে। উদ্বাস্তুদের জন্য জমির পাট্টা দেওয়ার ঘোষণাও অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। তবে নাগরিকত্ব বিল পাশ হলে মমতার উপরে চাপ আরও বাড়বে। আমার ধারণা তৃণমূল উদ্বাস্তু হিন্দুদের ভোটের কথা মাথায় রেখে এই নাগরিকত্ব বিল পাশ করাতে পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে সহযোগিতাই করবে। 

হিন্দু ভোট যত কনসলিডেট হবে, হিন্দু তোষণের প্রতিযোগিতা তত বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে লাখ টাকার প্রশ্ন থেকেই গেল - রাজ্যের রাজনীতিতে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকা মুসলিম ভোটের লোভে পড়ে রাজ্য বিজেপি নিজেদের পায়ে, সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী হিন্দুর পায়ে কুড়াল মারবে না তো? বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব এই সংগঠিত হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে taken for granted মনে করছে না তো!

Thursday, November 21, 2019

মেরুদণ্ডহীনতায় লজ্জিত হ‌ওয়ায় লজ্জা কিসের?

আজকের দিন, ২২শে নভেম্বর। সালটা ২০০৭। কলকাতার বুকে লুঙ্গি-টুপির তাণ্ডব চলছে। তসলিমাকে তাড়াতে হবে এই রাজ্য থেকে। কেন? উনি একটা ব‌ই লিখেছেন। নাম 'লজ্জা'। সেই ব‌ইয়ে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের একটা চিত্র তুলে ধরেছেন সাহসী তসলিমা। বাংলাদেশে প্রাণ সংশয়। তাই আশ্রয় নিয়েছেন প্রোগ্রেসিভ, লিবেরাল বাঙালির বাসস্থান এই কলকাতায়। হ্যাঁ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, কবি সৃজাত, শীর্ষেন্দু, গরুখেকো সুবোধ-বিকাশ কবীর সুমনদের কলকাতায়।

লুঙ্গি-টুপির তাণ্ডব চলছে তসলিমাকে তাড়াতে হবে। দুদিন ধরে বিনা বাধায়। নেতৃত্বে জনপ্রতিনিধি ইদ্রিস আলী। না, এর প্রতিবাদে একটাও মিছিল, যার সামনের সারিতে অপর্ণা সেন, সুবোধ বিকাশ - এই কলকাতার বুকে হয় নি। একটাও কবিতা সৃজাতদের কলম থেকে বেরোয় নি। দুদিন ধরে চলল এই তাণ্ডব। অবশেষে সকলের অসহায় আত্মসমর্পণ মুসলিম মৌলবাদের সামনে। তাড়ানো হল তসলিমাকে।

বুদ্ধিজীবীদের এই নীরবতা কি কলকাতার বাঙালির লজ্জা নয়? মরীচঝাঁপির ক্ষেত্রে আনকম্প্রোমাইজিং অবস্থান নেওয়া প্রবল প্রতাপশালী লাল সরকারের মুসলিম মৌলবাদীদের সামনে এই অসহায় আত্মসমর্পণ কি বামপন্থীদের লজ্জা নয়? 

না, এগুলো ওদের লজ্জিত করে না। কারণ এই পক্ষপাতমূলক আচরণটাই ওদের নীতি। কারণ এরা ওদের পক্ষে। মুক্তচিন্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা - এইসব তত্ত্বের অবতারণা তখনই হবে যখন আপনি এই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। এই সব তত্ত্ব বামৈস্লামিক দুষ্কৃতীদের প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অন্যতম অস্ত্র। এই সব‌ই আপনাকে আমাকে থামানোর জন্য।

এটা আসলে আমাদের‌ই লজ্জা। কারণ আমরা এই বামৈস্লামিক ষড়যন্ত্রের হাত থেকে তসলিমাকে বাঁচাতে পারিনি। কারণ আমরা আজও এই ভারতবিরোধী, হিন্দুবিরোধী বামৈস্লামিক শক্তিকে ভারতের মাটি থেকে শিকড়সমেত উপড়ে ফেলতে পারিনি। তাই যতদিন বামৈস্লামিক দুষ্কৃতীদের শিকার তসলিমাদের নিরাপত্তা দিতে না পারবেন, এদের ধ্বংস করে প্রকৃত মুক্তচিন্তার প্রতিষ্ঠা না করতে পারবেন, আসুন লজ্জিত হ‌ই। মেরুদণ্ডহীনতায় লজ্জিত হ‌ওয়ায় লজ্জা কিসের?

Sunday, October 6, 2019

বাঙালির থিম পূজো

বাঙালির উর্বর মস্তিষ্কের আবিষ্কারে দুর্গাপূজা হয়েছে 'থিম পূজো'। যে সমস্ত থিম দেখতে পাচ্ছি, তার বেশিরভাগ‌ই সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে দুর্গাপূজার প্রেক্ষাপটের সাথে সম্পর্কবিহীন বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপিত করে গর্বের সাথে বলা হচ্ছে - এবার আমাদের থিমপূজা হচ্ছে। এই থিম আগে স্থান পেতো মন্ডপের বাইরে, বিশেষত আলোকসজ্জায়। এখন মূল মন্ডপ এমনকি দুর্গামূর্তিও এই থিমের কবলে। আমরাও দেখতে যাচ্ছি, নতুন জামাকাপড় পরে, রাত জেগে!

থিমপূজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল বার্তাটা আমরা ধরতে পারছি না। সেটা হল - ধীরে ধীরে দুর্গাপূজার ধর্মীয় আঙ্গিককে গুরুত্বহীন করা হচ্ছে, বাঙালিকে ধর্মহীন করা হচ্ছে। দুর্গাপূজা থেকে দুর্গাপূজা বিহীন থিমপূজার একটা ট্রানজিটে আমরা অবস্থান করছি। এরপর হয়তো খালি প্রতীক হিসেবে ঘটপূজা হবে, মন্ডপসজ্জা এবং মূর্তিতে থিমের মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে 'ধর্ম যার যার, উৎসব সবার' গোছের কিছু সুচিন্তিত ন্যারেটিভ। তারপরের ধাপে শুধুই থিম, পূজা বাদ। প্রতিমা নিরঞ্জন উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা নয়, হবে কার্নিভাল, পাশ্চাত্যের অনুকরণে বড় বড় ছাতা থাকবে, ট্যাবলো থাকবে, থাকবে চোখ ধাঁধানো বিভিন্ন উপকরণ। মা দুর্গার প্রতিমা থাকবে না সেখানে। আগেই চুপেচাপে ঘট বিসর্জন হয়ে যাবে সবার অলক্ষ্যে! আমরা ধন্য হবো - আহা কী দেখিলাম, জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিবো না!

দিন আসছে, হয়তো বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকবে অন্নপ্রাসনের থিম, আর অন্নপ্রাসনের অনুষ্ঠানে শ্রাদ্ধের থিম। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা দুহাত তুলে বলবে, সাধু সাধু! কী ব্যতিক্রমী প্রয়াস! হোয়াট বেঙ্গল থিংক্স টুডে, ইন্ডিয়া থিংক্স টুমরো!

আজকে গোটা দুনিয়ার বুঝতে পারছে, আমরা, বাঙালিরা যা করে চলেছি তা উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় নয়, এটা একটা দেউলিয়া মানসিকতা, চূড়ান্ত অগভীর চিন্তাশক্তির প্রতিফলন।

বাঙালি তো বুদ্ধিবৃত্তিতে এরকম দীনহীন কখন‌ও ছিল না!!

দরকার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি

আমাদের কোনও কিছুকে আংশিক ভাবে দেখার পরিবর্তে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ব্যক্তি হোক, বস্তু হোক, ঘটনা হোক অথবা পরিস্থিতি হোক অথবা মতাদর্শ হোক; সার্বিকভাবে তার প্রভাব (impact), পরিনাম (consequences) অথবা উপযোগিতা (utility) বিচার করে তার গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারিত হ‌ওয়া দরকার।

মনে করুন একটা পিল, যাতে একটু পটাশিয়াম সায়ানাইড যার উপরে সুগার কোটিং দেওয়া আছে। কেউ বলবে ওটা মিষ্টি, কেউ বলবে ওটা বিষ। দুটোই সত্য। বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু ওটা খেলে তার পরিনাম কী হবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মানুষ সার্বিক পরিনামের কথা ভেবেই স্থির করবে ওই পিল খাবে কি খাবে না। যে মরতে চায় সে খাবে, আর যে বেঁচে থাকতে চায় সে খাবে না। কিন্তু যারা বক্তব্যের সত্যাসত্য নিয়ে শুধু লম্বা বিতর্ক‌ই করতে থাকবে, তাদের এই বিতর্কের মূল্য কি? তারা একবার বলবে পিলটা খুব মিষ্টি, আবার পরক্ষণেই বলবে পিলটা খুব বিষাক্ত। দুটোই সত্য হলেও এদের এই বিতর্ক কাউকে পথ দেখাবে না, শুধু বিভ্রান্ত‌ই করতে থাকবে। আপনাকে সার্বিক পরিনতির কথা ভেবেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কি করবেন।

একটা মতাদর্শের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। কতটা ঠিক, কতটা ভুল সেটা বিচার্য্য নয়। বিচার্য্য বিষয় হল এই মতাদর্শের সার্বিক পরিনাম দেশ ও জাতির উপরে কি হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলছি, গান্ধীর আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস, গোরক্ষায় আগ্রহ, অনারম্বর জীবনযাপন, রামরাজ্যের কল্পনা ইত্যাদি (সেগুলো ভন্ডামি না সত্য সে বিচারে যাচ্ছি না) দেখে আপনি তার প্রশংসা করতেই পারেন। পাশাপাশি ইসলামের বিষয়ে তার চূড়ান্ত সমঝোতার নীতি, অনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ইত্যাদি দেখে আপনি তার সমালোচনাও করতে পারেন। কিন্তু সার্বিক বিচারে আপনাকে স্থির করতে হবে, গান্ধীর নেতৃত্বে দেশ ও সমাজ নিরাপদ  ছিল কি না। হয়তো গান্ধীর অনেক কিছুই অনেকের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় থাকতে পারে। কিন্তু আজ প্রমাণিত যে টোটাল 'গান্ধী প্যাকেজ' দেশের এবং হিন্দুদের যে সর্বনাশ করেছে তা অপূরণীয়। 

আজও অনেকেই অনেক ন্যারেটিভ সামনে আনছেন বা এনেছেন। তার কতটা গ্রহণযোগ্য, কতটা নয় - এর পারসেন্টেজের হিসাব করে সেই ন্যারেটিভকে অনুসরণ করার পরিবর্তে দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নির্মাণে এদের টোটাল প্যাকেজের (ন্যারেটিভ, কার্যপদ্ধতি, নেতৃত্ব, কমিটমেন্ট ইত্যাদি) সার্বিক প্রভাব ও উপযোগিতা কতটা, সেটা ভেবেই সেই প্যাকেজের মূল্যায়ন করা উচিত। মূল্যায়ন করুন, সিদ্ধান্ত নিন, নিজেকে নিয়োজিত করুন। এদিক ওদিক হাতড়ে বেরিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। সময় আমাদের হাতে খুবই কম।

দুর্গাপূজা এখন শারদোৎসব

প্রথমে হলো দুর্গাপূজা থেকে দুর্গোৎসব। তাতে খুব একটা অসুবিধা নেই। কারণ বাঙালির উৎসব আর পূজাকে আলাদা করা যায় না। প্রায় সব উৎসবেই পূজার ছোঁয়া লেগে থাকে। দোল, মকর সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষ - সবেতেই পূজার একটা অংশ আছে।

কিন্তু এরপর দুর্গোৎসব হয়ে গেল শারদোৎসব। পূজা বাদ হয়ে যাওয়ার পরে দুর্গাও বাদ। পড়ে র‌ইলো শুধু উৎসব, যেটা শরৎকালে হয় বলে শারদোৎসব।

এরপরে এলো নতুন ন্যারেটিভ - ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। প্রতিমা নিরঞ্জন বাদ গেল, এলো কার্নিভাল। পূজা উদ্বোধনে রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর ভীড়। সেখানেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। বিধায়ক সেনবাবুর সাথে পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য জনাব হায়দার আলীকে থাকতেই হবে! লেটেস্ট ট্রেন্ড হল হিন্দু মহিলা নেত্রীর হিজাব পরে পূজা উদ্বোধন! মূর্তিমতি সেকুলারিজম(অবশ্য সেকুলারিজম কোন লিঙ্গের তা জানা নেই)!

এখন চলছে থিমের বোলবালা। অস্ত্রহীনা দুর্গামূর্তি! আজান মুখরিত মন্ডপ! বাঙালির দূর্গাপূজা থেকে আজান মুখরিত মন্ডপের এই যাত্রা আসলে একটা দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন। এই পরিকল্পনা হল ধীরে ধীরে বাঙালিকে তার চিরন্তন শক্তির উপাসনা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। এর সাথে বাঙালিয়ানার মধ্যে আরবের মরু সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় কেড়ে নিয়ে এই জাতিকে একটা আত্মপরিচয়বিহীন জনতার ভীড়ে রূপান্তরিত করার ষড়যন্ত্রের শিকড় আজ অনেক গভীরে পৌঁছে গিয়েছে। পচন শুরু হয়েছে মাথা থেকেই। এই যাত্রাপথ শেষ হচ্ছে বাঙালির সম্পূর্ণ ইসলামীকরণে। এই যাত্রা আসলেই বাঙালির অন্তর্জলি যাত্রা। এই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাঙালি জাতিকে স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর দায়িত্ব আজকের বাঙালি যুবসমাজকেই নিতে হবে।

গান্ধী একটা প্যাকেজ, বিষের থলি

'গান্ধী' একটা কমপ্লিট প্যাকেজ(বিষের থলি), আপোষ মীমাংসার জন্য জাতির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়ার নীতিই যার মূল। এই প্যাকেজের 'এই অংশটা ভালো' কিংবা 'ওই অংশটা খারাপ' এটা হয়না। তবুও হঠাৎ 'গান্ধী' কে গ্লোরিফাই করার একটা ট্রেন্ড নতুন করে শুরু হয়েছে। এর পরিণতি ভয়ংকর হবে। হিন্দুকে বাঁচতে হলে 'গান্ধীত্ব(😊)'-র  ঠিক বিপরীত পথে হাটতে হবে।

'গান্ধীর পথে চললে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হতে পারে' - খবরের কাগজে হেডলাইন। বক্তা নাকি আমাদের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদি সত্যি হয় তাহলে তাঁকে অনুরোধ করবো, জাতিকে নতুন করে বিভ্রান্ত করবেন না। 'গান্ধীর পথ'-এর পরিণাম দেশভাগ, হিন্দুদের গণহত্যা, হিন্দু নারীদের গণধর্ষণ, আমাদের উদ্বাস্তু হ‌ওয়া। এই পথের ফলশ্রুতি হল জাতীয় বিপর্যয়। আমরা এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাই না।

যে মুখে রামধুন, সেই মুখেই অন্যায়ের সাথে আপোষ করার পরামর্শ - এই ভন্ডামিকে গ্লোরিফাই করলে গোটা জাতিটাই ভন্ড(যেটুকু বাকি আছে) হয়ে যাবে। মোদিজীকে অনুরোধ, এই উপকারটুকু করবেন না। গান্ধী আজ অপ্রাসঙ্গিক। ওকে নতুন করে প্রাসঙ্গিক করে তুলবেন না।

নবরাত্রি পালন, মহিষাসুর মর্দিনী মা দু্র্গার উপাসনা আর গান্ধীভজনা একসাথে চলতে পারে না। এদুটো পরস্পরবিরোধী। যারা এটা করবেন, তাদের চেয়ে বড় ভন্ড এই দুনিয়ায় আর নেই।

Monday, September 30, 2019

পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র এবং তাদের অধিকার

পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী বাঙালি হিন্দুরা, যারা ভারতের মাটিকে মাতৃসম মনে করেন, তারাই পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র।

পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, ভারতের অন্য রাজ্য কিংবা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বসবাসরত একজন বাঙালি হিন্দু এরাজ্যে ফিরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চাইলে তিনি সর্বদা স্বাগত এবং ভূমিপুত্রের মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী।

২০শে জুন ১৯৪৭-এ বঙ্গীয় আইন পরিষদের ভোটাভুটিতে একজন মুসলমান‌ও পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে ভোট দেয় নি। সবাই চেয়েছিল সম্পূর্ণ বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাক।

এমনকি ১৯৪৬ এর সাধারণ নির্বাচন, যাতে মুসলিম লীগের মূল ইস্যু ছিল পাকিস্তান, সেই নির্বাচনে বাংলার মুসলমানেরা উজাড় করে লীগকে ভোট দিয়েছিল। অর্থাৎ প্রায় সব মুসলমান চেয়েছিল যে সম্পূর্ণ বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হোক। তাদের সমর্থনের ফলেই এই নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত সিটের ৯৫% লীগের পক্ষে যায়।

ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত বঙ্গের এক তৃতীয়াংশ ভুমি এই পশ্চিমবঙ্গ যে হিন্দুদের হোমল্যান্ড এবং বাঙালি হিন্দুরা যে এখানকার ভূমিপুত্র সে বিষয়ে এরপরেও কোনও সন্দেহ আছে?

ভারত উপমহাদেশে যে সংস্কৃতির জন্ম এবং ক্রমবিকাশ হয়েছে, তার অন্যতম মূল তত্ত্ব হল Live and let live. বহিরাগত আব্রাহামিক ভাবধারার মূলতত্ত্ব এই মাটিতে বিকশিত Live and let live সংস্কৃতির পরিপন্থী। তাই এই অসহিষ্ণু আব্রাহামিক ভাবধারায় যারা বিশ্বাস করে, তারা কিভাবে এই মাটির ভূমিপুত্র হতে পারে?

কেউ ভারতের নাগরিক হলেই কিন্তু সে এরাজ্যের ভূমিপুত্র হতে পারে না। ভূমিপুত্র একটা বিশেষ 'স্টেটাস'। সবাই ভারতের নাগরিক হলেও, ভারতের একতা ও অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও বিহারে একজন বিহারীর যে স্টেটাস, মহারাষ্ট্রে মারাঠির যে স্টেটাস, তামিলনাড়ুতে একজন তামিলের যে স্টেটাস, গুজরাটে একজন গুজরাটির যে স্টেটাস, আসামে একজন অহমীয়ার যে স্টেটাস, নাগাল্যান্ডে একজন নাগার যে স্টেটাস, পশ্চিমবঙ্গে একজন হিন্দু বাঙালির সেই একই স্টেটাস প্রাপ্য। এই অধিকার থেকে কেউ আমাদের বঞ্চিত করতে পারবে না।

পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত তফশিলি উপজাতির অন্তর্ভুক্ত বন্ধুরাও এখানকার ভূমিপুত্র বলে আমি মনে করি।

এছাড়াও যে সমস্ত অবাঙালি হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈনদের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে অথবা দীর্ঘ  সময় ধরে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, তাদের মধ্যে যারা নিজেদের আইডেন্টিটি বজায় রেখেও এখানকার ভূমিপুত্র হিন্দু বাঙালি সমাজ, আদিবাসী সমাজ এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল; তারা চাইলে তাদের সাথে এই ভূমিপুত্রের স্টেটাস ভাগাভাগি করে নিতে আমাদের কোনও আপত্তি থাকা উচিত নয় বলে আমি মনে করি।

মনে রাখতে হবে, ভারতের দশটা রাজ্যকে এবং রাজ্যের ভূমিপুত্রদের ৩৭১ ধারার মাধ্যমে বিশেষ স্টেটাস দেওয়া হয়েছে। আন্দামান এবং নিকোবর দীপপুঞ্জের ভূমিপুত্রদের 'আইল্যান্ডার কার্ড' এর মাধ্যমে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাই এই ভূমিপুত্রের লীগ্যাল স্টেটাসের কল্পনা মোটেই অলীক নয়। এর বাস্তবায়ন সম্ভব কিন্তু তার জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এই বাঙালি হিন্দু জাতীয়চেতনা কি বৃহত্তর হিন্দু অবধারণার পরিপন্থী?

আপনি আর আমি যখন এক জায়গায় আসি তখন কি নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে এক জায়গায় আসতে হয়? কয়েকজন ব্যক্তি নিয়ে যখন একটা পরিবার তৈরি হয়, তখন সেই পরিবারের সব ব্যক্তিকে তাদের ব্যক্তিসত্ত্বাকে বিসর্জন দিতে হয়? বরং যে ব‍্যক্তি বেশী প্রতিষ্ঠা অর্জন করে, পরিবারে তার গুরুত্ব বেশী থাকে, সে একজন দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে আলাদা সম্মান পায়। তাহলে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের অঙ্গ হতে হলে, সেখানে ভ্যালু অ্যাড করতে হলে বাঙালিকে তার জাতীয় পরিচয় বিলোপ করতে হবে কেন? কেন আমরা বৃহত্তর হিন্দু সমাজের গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে বাঙালি সমাজকে তৈরি করবো না? বাঙালির মাটি গেছে, মানুষ গেছে, আত্মসম্মান তলানিতে। সরকার এন‌আরসি আর ক‍্যাব করে দিলেই আমরা সন্তুষ্ট! এটাও যে আমাদের ডিমান্ডের জন্য হচ্ছে তাও তো নয়! অহমীয়া আন্দোলনের চাপে এই এন‌আরসি। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দু ফোর্জ ডকুমেন্ট তৈরি করিয়ে লুকিয়ে ভারতে থাকা পছন্দ করেছে, কিন্তু নিজদের নাগরিকত্বের দাবিতে মরণপণ আন্দোলন করেনি। এই অচেতন, পরনির্ভরশীল জাতিকে আত্মনির্ভর এবং স্বাভিমান সম্পন্ন হতে হলে নিজের জাতীয়চেতনাকে জাগাতেই হবে।

।।এ মাটি আমার মাটি, মাটির দখল ছাড়ছি না।।

Wednesday, September 11, 2019

ওরা পারে, কিন্তু আমরা পারি না

যৌক্তিকতা অথবা ঔচিত্যের প্রশ্নটা আলাদা। প্রশ্নটা হচ্ছে ওরা অস্ত্র মিছিল করছে, প্রশাসন নীরব। আমরা করলে প্রশাসন সক্রিয়। ওরা প্রতি সপ্তাহে রাস্তা বন্ধ করে নামাজ পড়ছে, আমরা বছরে এক দুবার রাস্তায় পূজোপাঠ করলে প্রশাসন বিভিন্ন ফরমান জারি করছে। ওরা মসজিদে দিনে পাঁচবার মাইক বাজাচ্ছে, আমরা বাজাতে চাইলে অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। আইনের শাসন শুধুমাত্র আমাদের উপরে, ওদের জন্য কনসেশন। আসলে কনসেশন নয়, এটা কম্প্রোমাইজ। সবক্ষেত্রে চূড়ান্ত কম্প্রোমাইজ। মাদানী সাহেব আসামে দাঙ্গা করার হুমকি দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকেন, দেবতনু ভট্টাচার্য আত্মরক্ষার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিতে আহ্বান করলে তার বিরুদ্ধে ১৫৩-র এ ধারায় ২৭টি মামলা হয়। ওরা পাকিস্তানের পতাকা তুলতে পারে, জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন সিটে বসে থেকে জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করতে পারে, সোস্যাল মিডিয়ায় হিন্দু দেবদেবীর অপমান করতে পারে, দেশের আইন না মানার ঘোষণা প্রকাশ্যে করতে পারে। অন্যায় হলেও পারে। এদিকে আমরা নিজেদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে বলে ক্ষীণ স্বরে চিৎকার করতে পারি, কিন্তু অধিকার আদায় করে নিতে পারি না। ওরা অন্যায় করছে বলে কিছুটা ভয়ে ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে তার প্রতিবাদ করতে পারি কিন্তু শেষমেশ ওদের থামাতে পারি না।

ওরা যেটা চায়, সেটা ন্যায়সঙ্গত না হলেও ওরা করতে পারে। আমরা ন্যায্য অধিকারও আদায় করতে পারি না। কেন?

প্রথমত, আমাদের মধ্যে আমাদের 'সামাজিক পরিচয়'-এর বোধ নেই। সমাজ হিসেবে 'আমরা' কারা? সমাজ হিসেবে আমাদের ইতিহাস কি? সমাজ হিসেবে আমাদের জয় এবং পরাজয়ের ঘটনাগুলো কি? সমাজ হিসেবে আমাদের সুখ ও দুঃখের ঘটনাগুলো কি? কোন্ কোন্ ঘটনায় সমাজ হিসেবে আমাদের লাভ হয়েছে? আবার কোন্ কোন্ ঘটনায় সমাজ হিসেবে আমাদের ক্ষতি হয়েছে? সমাজ হিসেবে আমাদের চোখে হিরো কে আর ভিলেন‌ই বা কে? শত্রু কে? মিত্র‌ই বা কে? গৌরবের চিহ্ন কোনগুলো? অপমানের চিহ্ন‌ই বা কোনগুলো? আমাদের কিসে ভালো আর কিসে খারাপ - এই সমস্ত বিষয়ে সমাজ হিসেবে আমাদের 'সামাজিক ঐক্যমত' আছে? নেই। থাকলে বাঙালি হিন্দুদের এই করুণ অবস্থা হতো না। কিন্তু এই 'সামাজিক ঐক্যমত' ওদের আছে। তাই ওরা পারে, আমরা পারি না।

দ্বিতীয়ত, সমাজবোধ না থাকলে একটা সমাজের জনসংখ্যা থাকতে পারে কিন্তু জনবল থাকে না। জনবল না থাকলে শেষ পর্যন্ত জনসংখ্যাটাও ধরে রাখা যায় না, অবক্ষয় হতে হতে একদিন বিনাশ হয়। সমাজবোধ হল সমাজের প্রাণ। সমাজবোধ না থাকায় বাঙালি হিন্দু আজকে প্রায় প্রাণহীন শরীরে পরিণত হয়েছে। আমাদের জনসংখ্যা আছে, জনবল নেই। ওদের জনসংখ্যাটাই জনবল, যেটা ক্রমাগত বাড়ছে। তাই ওরা পারে, আমরা পারি না।

তৃতীয়ত, নিজের সমাজের উত্থানের জন্য, অধিকার আদায় করে নেওয়ার জন্য মূল্য দিতে হয়, সমর্পণ করতে হয়। সময় দিতে হয়, অর্থ দিতে হয়, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিদ্যা, বুদ্ধি - সব ঢেলে দিতে হয়,  প্রয়োজনে রক্ত‌ও দিতে হয়। আমরা কি প্রস্তুত? ওরা জাকাত দেয়, ওরা জেহাদের টানে আত্মাহুতি দেয়, কেস খায়, জেল খাটে। তাই ওরা পারে, আমরা পারি না।

চতুর্থত, সমাজের 'Collective will' যাতে সমাজ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয় তার জন্য সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঠিক পরিচালনার জন্য পরিচালন সমিতিতে, মন্দির কমিটি, হাট/ বাজার কমিটি, পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে লোকসভা পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রে সঠিক প্রতিনিধিত্ব পাঠানোর জন্য ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। 'রাজনীতি পছন্দ করি না' গোছের ন্যাকামো করলে চলবে না। এটা সামাজিক দায়িত্ব। জনপ্রতিনিধিরা তার কাজ সঠিকভাবে না করলে সামাজিক আন্দোলন করতে হবে, রাস্তায় নামতে হবে। আমাদের কালেক্টিভ উইল ভোটে প্রতিফলিত হয় না, ওদের ভোটে তো হয়‌ই, অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রেও হয়। তাই ওরা পারে, আমরা পারি না।

সর্বোপরি সমাজকে ঠিক রাখার দায়িত্ব মহাপুরুষদের নয়, সাধারণ মানুষের। যাঁরা ব্যক্তিগত কাজের ব্যস্ততার মধ্য থেকে সময় বার করে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা মহান নন, তাঁরাই সাধারণ। একটা সমাজ তার সাধারণ সদস্যদের কাছেই এই দায়িত্ববোধ আশা করে। মহান ব্যক্তিত্বরা একটা সমাজের উপরি পাওনা।কিন্তু যারা এই দায়িত্ব এড়িয়ে যান, তারা সাধারণ নন, তারা Below Normal Standard. 'সবাই তো আর মহাপুরুষ হতে পারে না' - এ বড় চালাকির কথা! এই কথা বলে আমাদের সমাজের অধিকাংশ সদস্য তাদের সামাজিক দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। এই চালাকি চলবে না। আমাদের বাঙালি হিন্দু সমাজের মাথায় পচন ধরেছে। আমরা আমাদের নিজেদের সমাজকেই ঠকাই, ওরা নিজেদের সমাজকে ঠকায় না। তাই ওরা পারে, আমরা পারি না।

Sunday, September 8, 2019

এন‌আরসি - র ভিত্তিবর্ষ

এন‌আরসি - র ভিত্তিবর্ষ? ওটা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য হোক। বাস্তবে দেশভাগের পরে ওদের ভারতে এসে বসবাস করার কোনও নৈতিক অধিকার‌ই নেই। তাই ১৯৪৭ এর ১৪ই আগষ্টের পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা প্রত্যেক মুসলমান অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। ভুলে গেলে চলবে না অখণ্ড বঙ্গের ৯৩% মুসলমান পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছিল। বস্তুত এদের ভারতে লালন পালন করা মানে পাকিস্তানী কালসাপদের দুধকলা দিয়ে পোষা। এরা যেকোনো সময় ছোবল মারবেই মারবে। সুতরাং ভারতের শত্রুদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না।

পাশাপাশি, হিন্দুদের জন্য কিসের ভিত্তিবর্ষ? হিন্দুরা দেশভাগের আগে থেকে আজ পর্যন্ত ধর্মীয় আগ্রাসনের শিকার। ভবিষ্যতেও হতেই থাকবে। তাই পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে বসবাসকারী হিন্দু যেকোনো সময়ে ভারতে এসে নাগরিকত্ব চাইলে তাকে স্বাগত জানাতে হবে। বাঙালি হিন্দুর হোমল্যান্ড এই পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গ জন্ম নিয়েছিল এই উদ্দেশ্যেই। তাই বাঙালি হিন্দুদের জন্য কোনও ভিত্তিবর্ষ করাটা‌ই অযৌক্তিক। এদের অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে নাগরিকত্ব দিতে হবে।

এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাগুলো কি? সবথেকে বড় সমস্যা হল বাঙালি হিন্দুর মানসিকতা। যারা অত্যাচারিত হয়ে ওপার থেকে আসবেন, তারা ওপারে তাদের উপরে হ‌ওয়া অত্যাচারের কথা এপারে এসে কিছুতেই স্বীকার করবেন না! বরং কিছু লোক সুজন চক্রবর্তীদের ধামাধরে থাকবেন। নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এপারের মানুষকে ইসলামী আগ্রাসনের ব্যাপারে সচেতন করার পরিবর্তে তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ দেবেন। অনেকে আবার দলিত-মুসলিম ঐক্যের কথা বলে নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত থাকবেন। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আপনাদের যেমন অধিকার আছে, একটা দায়িত্ব‌ও তো আছে! এটাতো সত্য যে আপনারা এপারে এসে এপারের জমি, খাদ্য এবং কর্মসংস্থানের উপরে ভাগ বসাচ্ছেন। এটাযে একটা চাপ তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। যেভাবে আসামের অহমীয়ারা প্রতিক্রিয়া করেছে বা করছে, সেভাবে এপারের বাঙালি হিন্দুরা এখনও পর্যন্ত এর বিরোধিতা না করলেও একটা চাপা অসন্তোষ যে আছে, এবং সেটা স্বাভাবিক তা অস্বীকার করা যায় না। 

এর সমাধান কি? সোজা কথায় অবৈধ মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের দখল করা জমি, খাদ্য ও কর্মসংস্থানের জায়গা ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে নব্য নাগরিকদের পুনর্বাসন হবে। তাই এন‌আরসি চাই। সঠিকভাবে এবং কঠোরভাবে চাই। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হিন্দু বাঙালিদের সংখ্যার সমানুপাতে বাংলাদেশ থেকে জমি আদায় করতে হবে।

এই লড়াইয়ের পুরোভাগে নব্য নাগরিকদের‌ই থাকতে হবে এবং সম্পূর্ণ বাঙালি জাতিকে এই আন্দোলনে যোগদান করতে হবে। এভাবেই নবকলেবরে জেগে উঠবে বাঙালি জাতি এবং সার্থক হবে পশ্চিমবঙ্গের জন্মের উদ্দেশ্য। আমার বিশ্বাস, এতে পারস্পরিক আস্থা ও সম্মানের জায়গাটা অত্যন্ত সুদৃঢ় হবে, যা একটা শক্তিশালী জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য খুবই প্রয়োজন।

অনেকে আসামের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গে এন‌আরসি - র বিরোধিতা করছেন। তাদের অবৈধ মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদে স্টটলেস করার প্রয়োজনীয়তার কথাটা চিন্তা করা দরকার। এরা থেকে গেলে এন‌আরসি আটকে আপনারা যাদের বাঁচাতে চাইছেন, তারাও বাঁচবে না। বাংলাদেশে এন‌আরসি হয় নি, তথাপি হিন্দুরা উদ্বাস্তু হয়েছে। ডোমোগ্রাফিটা একবার পাল্টে গেলে এক‌ইভাবে আমরাও উদ্বাস্তু হবো। তাই গঠনমূলক দৃষ্টিতে এন‌আরসি কে দেখুন। পশ্চিমবঙ্গে এন‌আরসি হতেই হবে, কিন্তু সেটা যাতে আমাদের শর্তেই হয় তারজন্য রাস্তায় নামতেই হবে।

Saturday, August 31, 2019

এন‌আরসি, আসাম এবং বাঙালি হিন্দু

আসামে এন‌আরসি এক কথায় পর্বতের মূষিক প্রসব। বরং এই এন‌আরসি-র ফলশ্রুতিতে বাঙালি হিন্দুদের একটা বিরাট অংশ ( সেটা ৯ লাখ না ১১ লাখ জানিনা) আজ অনিশ্চয়তার সামনে। হিন্দু সংহতি এদের পাশে থাকবে। ভারতে থাকার অধিকার এদের আছে, সেই অধিকার আদায় করার লড়াইয়ে আমরা সাথে ছিলাম, আছি  আর থাকবো।

৩৭০ ধারা রদ হলো। সারা দেশে 'এক নিশান, এক বিধান, এক প্রধান' প্রতিষ্ঠিত হ‌ওয়ার দিকে আমরা একধাপ এগিয়ে গেলাম। আর আজ বিজেপি শাসিত আসামে কেন্দ্রের 'পাসপোর্ট আইন ২০১৫' মূল্যহীন! এই আইনে বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় কারণে বিতাড়িত হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় নিলে তাদের ভারতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সারা ভারত এই আইন মেনে চলবে, আর আসামে তা চলবে না, চলবে 'আসাম চুক্তি'! বিজেপির   কেন্দ্রীয় সরকার প্রণোদিত 'পাসপোর্ট আইন ২০১৫' কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিজেপি শাসিত আসাম রাজ্যে এন‌আরসি-র ভিত্তি আজ কংগ্রেস জমানার সেই 'আসাম চুক্তি'! কেন্দ্রের এই আইনের সুবিধা সারা ভারতের হিন্দু শরণার্থীরা পাবে, কিন্তু আসামের বাঙালি হিন্দু শরণার্থীরা পাবে না!

এই বৈষম্য চলবে না। আমরা আসামের শরণার্থী হিন্দুদের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্র বিরোধিতা করছি। কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসামের রাজ্য সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, একজন শরণার্থী বাঙালি হিন্দুকেও যেন বিদেশী বলে গ্রেফতার অথবা বিতাড়িত করা না হয়। পাশাপাশি এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে হিন্দু সংহতি শীঘ্রই সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থে মামলা দায়ের করতে চলেছে।

কিন্তু সব থেকে বড় প্রশ্ন, যে কয়েক লাখ হিন্দুর নাম বাদ গেল, তারা কি করবে? হয় তাদের বৈধ কাগজপত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তারা বিদেশী নয়। অথবা তাদের মুক্তকন্ঠে স্বীকার করতে হবে যে তারা বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় কারণে বিতাড়িত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দু রাস্তায় নামবেন? অন্তত এদের ১০-১৫% লোক? বড় কঠিন প্রশ্ন! রোহিঙ্গাদের দেখছি আর অবাক হচ্ছি। বুক ঠুকে বলে বেড়াচ্ছে, হ্যাঁ আমরা বিতাড়িত। থাকতে দিতে হবে, সুযোগ সুবিধা দিতে হবে, জল দিতে হবে, খাবার দিতে হবে। সবাই দিচ্ছেও ওদের! কতজন ওরা সর্বসাকুল্যে? আর আমরা আসামে কত লক্ষ? ওরা পারছে, আমরা পারছি না কেন?

Wednesday, August 28, 2019

পশ্চিমবঙ্গে জনজাগরণ

পশ্চিমবঙ্গে জনজাগরণ! এর মানে কি? বাঙালির জাগরণ ঘটানোর দরকার আছে? বাঙালি এত যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে কিভাবে? দেশ হারিয়ে উদ্বাস্তু হ‌ওয়ার যন্ত্রণা! প্রিয়জনের নির্মম হত্যা, ধর্ষণের প্রত্যক্ষদর্শী হ‌ওয়ার যন্ত্রণা! শরীরের রক্ত জল করে গড়ে তোলা বাড়ি, ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যা‌ওয়ার যন্ত্রণা! কার‌‌ও দিদি, কার‌ও বোনকে ভাগ করে নিলো ওরা নিজেদের মধ্যে গণিমতের মাল হিসেবে। এদিকে অসহায়, ফ্যালফ্যাল করে পিছনের দিকে তাকাতে তাকাতে কাঁটাতার পেরিয়ে এপারে চলে আসা বাঙালি, বুকে আজও সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে কিভাবে? ওপারে মালাউনের বাচ্চা, এপারে রিফিউজির বাচ্চা তকমা নিয়ে বাঙালি ঘুমায় কিভাবে! ওপারের নোয়াখালী, ভৈরবের চরের রক্তাক্ত পথ ধরে এপারের নলিয়াখালি, দেগঙ্গা, বাদুড়িয়া, ধূলাগড়, বগাখালিতে পৌঁছে বাঙালি আজ ঘুমিয়ে থাকে কিভাবে! আমি বিশ্বাস করি না বাঙালি ঘুমিয়ে আছে। তাই তাকে জাগানোর চেষ্টা করোর কোনও প্রয়োজন নেই। বাঙালি প্রতি মুহূর্তে চিৎকার করে তার যন্ত্রণাকে ব্যক্ত করতে চায়। কিন্তু তার কথা শোনে কে? সেকুলারিজম আর লিবারালিজমের ভন্ডামির ঢাকের আওয়াজে বাঙালির এই চিৎকার চাপা পড়ে আছে আজও। তাই প্রশ্ন হলো আজ কে কাকে জাগাবে? যারা জনজাগরণ করতে চাইছে তারা নিজেরাই আগে জাগ্রত হয়ে কান পাতুক বাঙালির মনের মণিকোঠায়। জানার চেষ্টা করুক বাঙালির সামনে প্রায়োরিটি কি - রাজ্যব্যাপী অসংখ্য স্থানে মগরাহাটের সেলিম, জীবনতলার সৌকত মোল্লা, সরবেড়িয়ার সাজাহান শেখ, হাসনাবাদের বাবু মাস্টার, কীর্ণাহারের মনিরুল, ভাঙ্গড়ের আরাবুল-কাইজার, মিনাখাঁর আয়ুব গাজীদের পরিচালিত সমান্তরাল জেহাদী শাসনের অবসান, নাকি ইলেকট্রিক বিলের খরচা কমানো।

Tuesday, August 27, 2019

বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত না করে পশ্চিমবঙ্গে এন‌আরসি করার চেষ্টা হলে তার তীব্র বিরোধিতা করা হবে

আসামে ‌এন‌আরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হতে চলেছে ৩১শে আগষ্ট। এই তালিকা অনুযায়ী যাঁঁরা বিদেশী বলে ঘোষিত হবেন, সরকার তাঁঁদের আশ্বস্ত করেছে যে তাঁঁরা ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী বাঙালি হিন্দুদের, যাঁঁরা ৭১এর পরে ভারতে এসেছেন, তাঁঁদের জন্য কি ধরণের সুরক্ষা কবচ থাকছে সে সম্পর্কে আমার এখনও কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। কারণ নাগরিকত্ব আইন এখনও প্রণয়ন করা সম্ভব হয় নি, আর আগের টার্মে মোদি সরকার যে নোটিফিকেশন জারি করে সাময়িক ভাবে উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালিদের একটা সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল, সেটাও এখন বলবৎ আছে কি না জানি না। অবশ্য এই নোটিফিকেশন আসামে কতটা কার্যকরী ছিল, সেটাও একটা বড় জিজ্ঞাসা। তাই শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে সেটা এখন কেউ সঠিকভাবে বলতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে ৩৭০ ধারা বিলোপকারী এই কেন্দ্রীয় সরকারের যে একটা সদিচ্ছা আছে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। বস্তুতঃ একমাত্র এই সদিচ্ছাই এখন আসামের বাঙালি হিন্দুর সব থেকে বড় ভরসা। এখন মোদি-শাহ্ যদি সর্বোচ্চ আদালতের কোর্টে বল ঠেলে দেন, সেটা হবে বাঙালি হিন্দুর ইতিহাসে সবথেকে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।

আসামের উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দুর কি হতে চলেছে সেটা সময় বলবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও তো এন‌আরসি হ‌ওয়া দরকার। আমরা প্রথম থেকেই বলে এসেছি জাতীয় স্বার্থে এন‌আরসি চাই। ভারতবর্ষ সরাইখানা নয়। রাজ্য থেকে অবৈধ মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াতে হবেই। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে এই অবৈধ অনুপ্রবেশের ফলে‌। ১৯৪৭ এর ২০শে জুন প্রস্তাবিত পাকিস্তানের বুক চিরে এই পশ্চিমবঙ্গের জন্ম‌ই হয়েছিল বাঙালি হিন্দুর হোমল্যান্ড হিসেবে। কিন্তু আমরা দেখছি দেশভাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত উদ্বাস্তু হিন্দু জনস্রোতকে টেক্কা দিয়ে লাগাতার অবৈধ মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে আমাদের রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলায় ইতিমধ্যেই বাঙালি হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে।  এক‌ই চিত্র বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন বেশিরভাগ ব্লকে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি চরিত্র বজায় রাখতে হলে অবিলম্বে এন‌আরসি শুরু করা আবশ্যক। কিন্তু আমরা ঘর পোড়া গরু। আসামে উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দুরা যে অনিশ্চয়তার সামনে পড়েছে, আমাদের রাজ্যে যাতে তা না হয়, তারজন্য ভাবত হবে বৈকি! তাই  আমরা মনে করি বাংলাদেশ থেকে যে অত্যাচারিত বাঙালি হিন্দুরা শরণার্থী হিসেবে এই পশ্চিমবঙ্গে আসতে বাধ্য হয়েছে, তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টাকে প্রাথমিকতা দিতে হবে।

আমাদের স্পষ্ট দাবি - প্রথমে পশ্চিমবঙ্গে আগত শরণার্থী বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করতে হবে। তারপরে এন‌আরসি শুরু করতে হবে। তা না হলে বাঙালি হিন্দুরা ব্যাপক অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা শুধুমাত্র মৌখিকভাবে দিলে হবে না। আগে নাগরিকত্ব আইন পাশ করাতে হবে, তারপরে এন‌আরসি। নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন না করে পশ্চিমবঙ্গে এন‌আরসি চালু করার চেষ্টা করলে হিন্দু সংহতি তার তীব্র বিরোধিতা করবে।

Wednesday, August 14, 2019

হিন্দু সংহতি প্রযোজিত তথ্যচিত্র

১৯৪৬ এর ১৬ই আগষ্ট আমার  জাতিসত্তাকে খুন করার দিন। বিশ্বাসঘাতক মুসলিম লীগের হিন্দু গণহত্যার দিন। কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতাকে সনাতনী রক্তের নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার দিন। আবার ১৯৪৬ এর ১৬ই আগষ্ট আমাকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রেরণাও দেয়। আত্মবিস্মৃত বাঙলার হিন্দু সমাজকে নতুন করে জিহাদী অত্যাচারের ইতিহাসের সামনে বার বার দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্যই হিন্দু সংহতির জন্ম। হিন্দু সংহতির জন্ম নতুন ইতিহাস গড়ার জন্যও। অবশ্যই দেখুন ও শেয়ার করুন
হিন্দু সংহতি মিডিয়া প্রোযোজিত
ডকুমেন্টারি,
" রক্ত শোধের দিন, ১৬ই আগষ্ট।"

Tuesday, August 13, 2019

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি

বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। আমার সাধারণ বুদ্ধিতে ওখানে হিন্দুর শেষ হয়ে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। ভারত সরকার হয়তো পাশেই চিনের উপস্থিতির কথা ভেবে বাংলাদেশের হাসিনা সরকারকে ফেভার করছে। কিন্তু সেখানকার হিন্দুদের নিরাপত্তা বলে আর কিছুই নেই।

একটা আন্তর্জাতিক চাপকে সামনে রেখেই এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব। তারজন্য এপারে পালিয়ে আসা হিন্দুদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি।

এদেরকে ভারতে একটা হলফনামা দিয়ে স্বীকার করতে হবে যে তারা ওপারে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অত্যাচারিত হয়ে অথবা সম্ভাব্য অত্যাচারের আশঙ্কায় ভারতে এসেছে।

কয়েক লাখ হলফনামাকে ভিত্তি করে একটা বিরাট আন্তর্জাতিক চাপ বাংলাদেশ সরকারের উপরে সৃষ্টি করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে চিনের হস্তক্ষেপকেও আটকানো যেতে পারে। তখন অনেকগুলো বিকল্প পথ হিন্দুদের সামনে খুলে যাবে বলে আমার ধারণা -

১) হিন্দুদের জন্য কয়েকটি স্বায়ত্বশাসিত জেলা এবং সেই জেলাগুলোতে ভারতীয় সেনার উপস্থিতি।

২) বাংলাদেশ ভেঙে হিন্দুদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন, পরে ভারতের অন্তর্ভূক্তি।

আজকে অবাস্তব মনে হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। কিন্তু বাঙালি হিন্দু নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে উঠতে পারবে, সবটাই তার উপরে নির্ভর করছে।

Sunday, August 11, 2019

শিয়ালদহ রেল স্টেশন‌ই বাঙালি-হিন্দু নির্যাতনের আদর্শ স্মারক

দেশভাগের সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুদের যে অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে, তার থেকে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস এই পৃথিবীতে আর নেই। হিন্দু হলোকাস্টের স্মৃতিস্বরূপ একটা মনুমেন্ট এই পশ্চিমবঙ্গে থাকার দরকার ছিলো না? আপনারা সেই ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে যেতে চান? আগামী প্রজন্মেকে সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চান?ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার অর্থ আগামী প্রজন্মকে সেই একই  ঐতিহাসিক পরিস্থিতির শিকার হ‌ওয়ার‌ দিকে ঠেলে দে‌ওয়া।

হিন্দু সংহতি সেই ইতিহাস ভুলতে দেবে না। আমরা মনে করি এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বাঙালি হিন্দু আবার ঘুরে দাঁড়াবে, যেভাবে ১৯৪৬ এ গোপাল মুখার্জীর নেতৃত্বে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। বাঙালি হিন্দু যে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি, নির্মম-নিষ্ঠুর ভিসুভিয়াস্ - এই উপলব্ধি বাঙালি হিন্দুর না হলেও সুরাবর্দী সহ মুসলিম গুন্ডাদের সেদিন নিশ্চিতরূপে হয়েছিলো। মাথায় হাত দিয়ে লালবাজারে বসে পড়েছিলেন তিনি। বাঙালি আজ উদাসীন, হতাশ তার কারণ বাঙালির ইতিহাস বিস্মৃতি। এই ইতিহাস ভুলতে দেওয়া যাবে না।

দেশভাগের শিকার বাঙালি হিন্দুর উপরে অবর্ণনীয় অত্যাচারের স্মৃতি বহন করবে এই রকম একটা মনুমেন্ট এই কলকাতায় চাই ই চাই। আমার ধারণা এই ইতিহাসের সবথেকে বড় সাক্ষী এই শিয়ালদহ রেল স্টেশন। শিয়ালদহ রেল স্টেশন‌ই সেই আকাঙ্ক্ষিত মনুমেন্ট হতে পারে। আসুন, শিয়ালদহ রেল স্টেশনকে #ডঃ_শ্যামাপ্রসাদ_মুখার্জী_টার্মিনাস্ নামকরণ করার মাধ্যমে তাকে বাঙালি হিন্দুদের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের স্মারক হিসেবে গড়ে তোলার দিকে একধাপ এগিয়ে যাই।

Saturday, August 10, 2019

হালাল কি এবং কেন এটি বর্জন করা প্রয়োজন

অনেকের ধারণা একমাত্র জবাই করে কাটা পশুর মাংসই হলো হালাল। বাস্তবে হালাল শব্দের অর্থ ‘ইসলাম অনুযায়ী বৈধ’ অথবা ‘শরিয়া আইন দ্বারা অনুমোদিত’। ইসলামের অনুশাসন অনুযায়ী জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই হালাল(বৈধ) এবং হারাম(অবৈধ) এর বিধান নিশ্চিত করে বলা আছে। মুসলমানদের জন্য সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত সব কার্যকলাপ ফরজ(কর্তব্য), মুস্তাহাব(প্রস্তাবিত), হালাল(বৈধ), হারাম(অবৈধ) এবং মক্রুহ্(বৈধ নয়, আবার একেবারে নিষিদ্ধও নয়)- এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা আছে।
খাদ্যের মধ্যে মূলতঃ শুকর, জবাই না করে কাটা পশুপাখী, আল্লাহ্-র নাম না নিয়ে জবাই করা পশুপাখী, রক্ত, নেশার বস্তু(মদ সহ), মৃত পশুপাখীর মাংস(তবে মৃত মাছ বাদে) – এগুলো হারাম। তবে কোরানে একথাও বলা আছে যে যখন হারাম খাবার না খেলে বেঁচে থাকা যাবে না, তখন জীবন রক্ষার্থে হারাম খাবারও হালাল হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও নামাজ পড়া, অজু করা, স্ত্রী সঙ্গম, লুটের মাল গ্রহণ থেকে শুরু করে মল-মূত্র ত্যাগেও হালাল-হারামের ব্যাপার স্যাপার আছে।
বিশ্বব্যাপী বিশাল মুসলিম জনসংখ্যা একটা লোভনীয় বাজার। এই বাজারকে কাজে লাগিয়ে ইসলামী উম্মা-র শক্তিবৃদ্ধি করা, বিশেষতঃ অমুসলমানদের কাছ থেকেও এই কাজে শক্তি সংগ্রহ করার কৌশলের নাম হলো হালাল সার্টিফিকেশন। পৃথিবীতে অনেকগুলো সংস্থা তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন প্রোডাক্ট, ব্র্যান্ড, রেস্টুরেন্টকে হালাল সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য। এই সার্টিফিকেটের বিনিময়ে মোটা টাকা বিভিন্ন কোম্পানীর কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনবাজারে নিজেদের মাল বিক্রীর লোভে বড় থেকে ছোট অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এই হালাল সার্টিফিকেট কেনে মোটা টাকার বিনিময়ে। ভারতে হালাল সার্টিফিকেশনের বড় সংস্থাগুলি হলো গ্লোবাল ইসলামিক শরিয়া সার্ভিসেস্ (GISS), হালাল ফুড অথরিটি (HFA), জমিয়ত উলেমা–এ–হিন্দ হালাল ট্রাস্ট প্রভৃতি। আমরা অনেকেই কেএফসি, জোম্যাটো প্রভৃতি ব্র্যান্ডের খাবার খেয়ে থাকি, যে ব্র্যান্ডগুলো হালাল সার্টিফায়েড। এছাড়াও ভারতের ছোট-বড় অধিকাংশ হোটেল-রেস্টুরেন্টেই হালাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি বড় বড় হরফে লেখা থাকতে দেখা যায়। এখন পাড়ায় পাড়ায় মাংসের দোকানগুলোতেও হালাল ছাড়া পাওয়া যায় না। যদিও আগেই বলেছি হালাল সার্টিফিকেশন শুধুমাত্র খাদ্যাখাদ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ওষুধপত্র, এফএমসিজি প্রোডাক্টও এর আওতায় পড়ে।
ষ্টেট অফ গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমী নামক সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী  বিশ্বব্যাপী হালাল সার্টিফায়েড  সামগ্রীর বাৎসরিক বাজার মূল্য ২.১ লক্ষ কোটি ডলারেরও বেশী। এই বিপুল টাকার একটা অংশ নিয়মিতভাবে কট্টর ইসলামিক সংস্থাগুলোর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, যারা হালাল সার্টিফিকেট দেওয়ার অধিকারী। এখন এই টাকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্মান্তরণের কাজে, শরিয়া আইন প্রচারের কাজে ব্যবহার হচ্ছে না কিংবা জাহাদী সন্ত্রাসবাদীদের হাতে অথবা ভারতের শত্রুদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে না তা নিশ্চিত করে কে বলতে পারে?
এবার একটু মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা যাক এই হালাল এবং আমাদের ঝটকা মাংসের বিষয়টাকে।  হালালের সময়, একটি ধারালো ছুরিকে প্রাণীটির গলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ছুরিটিকে না তুলে বারবার গলায় চালানো হয় যাতে শ্বাসনালী, খাদ্যনালী, মস্তকে রক্তসংবহনকারী স্কন্ধদেশের ধমনী (carotid arteries), স্কন্দদেশের শিরা (jugular vein) এবং ভেগাস স্নায়ু খণ্ডিত হয়। এতে শরীর থেকে রক্ত নির্গত হতে থাকে এবং প্রাণীটি পরিণামে প্রাণ হারায়। এই পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বলে ventral neck incision (VNI)। এতে মেরুদণ্ডের স্নায়ুতন্ত্র প্রাণীটির মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত অক্ষত থাকে। অপরপক্ষে আমাদের ঝটকা পদ্ধতিতে হত্যার সময়, ঘাড়ের পিছনের দিকে (dorsal neck) কাটা হয় যাতে মাথার খুলিকে মেরুদণ্ডের সুষুম্নাকাণ্ড (spinal cord) থেকে নিমেষে আলাদা করা হয়। কেবল ঘাড়ের কর্তন (cervical dislocation)-ই নয়, বরং এক আঘাতে মস্তকের শরীর থেকে বিচ্ছন্ন করাই এর উদ্দেশ্য। তাই এই পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয় অপেক্ষাকৃত ভারী এবং ধারালো অস্ত্র। সাধারণভাবে আমাদের শরীরের, আরও সঠিকভাবে বললে সোমাটিক কোষগুলো থেকে কোন অনুভূতি কিছু বিশেষ প্রোটিন (বৈজ্ঞানিক পরিভাষায়, cognate receptor proteins) লাভ করে যারা সেই অনুভূতিকে স্নায়ুর মাধ্যমে প্রেরণ করে। স্নায়ু আসলে কিছু নিউরোণ কোষের সমষ্টি মাত্র। স্নায়ু অনুভূতিকে মেরুদণ্ডের সুষুম্নাকাণ্ডের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। মস্তিষ্ক এই অনুভূতির প্রতিক্রিয়া সেই সুষুম্নাকাণ্ডের নিউরোণের মাধ্যমেই পাঠায় মাংসপেশীগুলিতে (effector muscles)। মাংসপেশীগুলি মস্তিষ্ক প্রেরিত বার্তাকে ক্রিয়াতে রূপ দেয়। হালালের সময় এই তীব্র যন্ত্রণার অনুভুতি পাঠানোর স্নায়ু বিচ্ছিন্ন হয় না। ফলে পশুটি সেই যন্ত্রণা সম্পূর্ণ সচেতনভাবে অনুভব করতে থাকে। পক্ষান্তরে ঝটকার সময় এই পথটিকে নিমেষের মধ্যে ছিন্ন করা হয়। ফলে ঝটকার সময় বলিপ্রদত্ত প্রাণীটির ব্যথার অনুভূতি সেই মুহূর্তেই হারিয়ে যায়। ব্যথা পরিমাপের এক স্বীকৃত পদ্ধতি হল ইইজি বা ইলেক্ট্রো এনসেফ্যালোগ্রাম। এই যন্ত্রটি মস্তিষ্কের নিউরোণের বৈদ্যুতিক বার্তাকে পরিমাপ করে। গরু বা ভেড়ার মত শান্ত প্রাণীরা তাদের যন্ত্রণার অনুভূতিকে বাইরে সবসময় প্রকাশ করে না। কিন্তু ইইজি পদ্ধতিতে তাদের ব্যথা স্পষ্টতই প্রকাশ পায়। বৈজ্ঞানিকরা দেখিয়েছেন যে ঝটকা পদ্ধতিতে প্রাণীবধ করলে শিরচ্ছেদের ৫ সেকেণ্ডের মধ্যেই মস্তিষ্কের (cerebral cortex) কার্য বন্ধ হয়। কিন্তু হালালের ক্ষেত্রে প্রাণীটি অনেক সময়ে তার শরীর থেকে চামড়া ছাডিয়ে নেওয়া পর্যন্ত, এমনকি তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শরীর থেকে আলাদা করা পর্যন্ত সচেতন অবস্থায় সেই তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে। এবার আপনারাই ভাবুন কোন পদ্ধতিটা তুলনামূলক মানবিক!
এবার দেখা যাক আমাদের স্বাস্থ্যের উপরে হালাল এবং ঝটকা মাংসের প্রতিক্রিয়া কি। বিভিন্ন গবেষকরা বারবার প্রমাণ করেছেন যে হালাল পদ্ধতিতে প্রাণীবধের সময় প্রাণীগুলি ভীষণ বেদনা বা স্নায়ুমণ্ডলীর ধকল (stress) অনুভব করে। গরু-ষাঁড়, ছাগল ইত্যাদি প্রাণীর ক্ষেত্রে এর ফলে তিনটি ষ্ট্রেস হরমোন (stress hormones), যথা কর্টিসোল (cortisol), নর-এড্রিনালিন (nor-adrenaline) এবং ডোপামাইন (dopamine) ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কারণটি খুবই সরল,  এই তিনটি হরমোন সমেত আমাদের বেশির ভাগ হরমোনের নিঃসরণই মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অঞ্চলের  দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমেরিকান বৈজ্ঞানিক টেম্পল গ্র্যাণ্ডিন দেখিয়েছেন  যে প্রাণীদের সংজ্ঞাহীন করে (stunning) হত্যা না করলে রক্তে কর্টিসোলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং তাতে মাংসপেশীর তাপমাত্রাও বাড়ে। সাধারণত স্নায়বিক ধকলের কারণে এড্রিনালিন হরমোনের পরিমিত ক্ষরণে মাংসপেশীর গ্লাইকোজেন ল্যাকটিক অ্যাসিডে পরিণত হয়। ফলে মাংসের পিএইচ কমে (অর্থাৎ  মাংস অ্যাসিডিক হয়)। তার ফলে মাংস যে কেবল গোলাপী এবং নরম থাকে তাই নয়, উপরন্তু মাংসে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পায় না। অপরপক্ষে প্রাণীটিকে যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতিতে হত্যা করলে স্নায়ুর ধকল বাড়ে। ফলে এড্রিনালিন হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণে মাংসপেশীর গ্লাইকোজেন খুব তাড়াতাড়ি নিঃশেষিত হয়। ফলে মাংস যথন রান্না করা হয় ততক্ষণে তাতে আর ল্যাকটিক অ্যাসিড অবশিষ্ট থাকে না। ফলে মাংসের পিএইচ বাড়ে এবং ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। অর্থাৎ, হালাল মাংস স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে।
সব থেকে বড় কথা, এই হালাল হলো মুসলমানদের জন্য শরিয়া অনুমোদিত ব্যবস্থা। এই শরিয়া ব্যবস্থা আমাদের মত অমুসলমানদের জন্য নয়। তাহলে আমরা আংশিক হলেও এই রিগ্রেসিভ, অবৈজ্ঞানিক এবং অমানবিক ইসলামিক শরিয়া আইন নিজেদের উপরে চাপিয়ে নিচ্ছি কেন? আমরা কি এতটাই অসহায় এবং অযোগ্য যে ইসলামের এই সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের সামনে আজ আমাদের নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণ করতে হবে? আমাদেরও তো একশ কোটির বাজার আছে! প্রয়োজনে আমরাও কি বিকল্প একটা সনাতনী স্টান্ডার্ডের কথা ভাবতে পারি না?
যাইহোক, সব দিক থেকে বিচার করলে এই হালাল ব্যবস্থা অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক, অমানবিক, ইসলামের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের নামান্তর। সর্বোপরি আমাদের এই পদ্ধতির মাধ্যমে আংশিকভাবে ইসলামিক শরিয়া আইন পালনে বাধ্য করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত অপমানজনক। তাই আসুন আমরা আপাতত সংকল্প করি আর হালাল নয়, আর অবৈজ্ঞানিক এবং অমানবিক রিগ্রেসিভ ভাবধারার দাসত্ব নয়। আসুন আজ থেকেই সবাই হালাল বর্জন করি।

Tuesday, May 28, 2019

আইডেনটিটির ইস্তেমাল

বাংলাদেশের এক‌ই গ্রাম থেকে দুজন মুসলমান ভারতে ঢুকলো। একজন গেলো আসামের অহমীয়া প্রধান জোরহাটে, অন্যজন সেই আসামের‌ই বাঙালি অধ্যুষিত হাইলাকান্দিতে।

প্রথম জন নিজের পরিচয় দেবে - আমি একজন অহমীয়া। ভাঙাফাটা অসমীয়া ছাড়া কখনোই সে বাংলায় কথা বলবে না। বাঙালি দেখলে বলবে কেলা বঙ্গালি। সে তাম্বুল পান খাবে। বিহুতে আনন্দ করবে। তার বাংলাদেশী পরিচয় লুকিয়ে তখন সে একজন ভূমিপুত্র অহমীয়া।

দ্বিতীয় জন কাঁচা কাছাড়ি ভাষায় কথা বলবে।  জনগণনার সময় নিজের পরিচয় নথিভুক্ত করাবে বাঙালি হিসেবে। সে তাম্বুলের পরিবর্তে সাদার গুড়া(তামাক পাতার গুড়ো) দিয়ে পান খাবে। বিহুর পরিবর্তে সে গাইবে - কে যাস্ রে ভাটিগাঙ্ বাইয়া....., সে নাচবে ধামাইল। সে একজন বাঙালি।

এই গেমপ্ল্যানটা বুঝতে হবে। না বুঝলেই আবার রিফিউজি।