Sunday, October 6, 2019

বাঙালির থিম পূজো

বাঙালির উর্বর মস্তিষ্কের আবিষ্কারে দুর্গাপূজা হয়েছে 'থিম পূজো'। যে সমস্ত থিম দেখতে পাচ্ছি, তার বেশিরভাগ‌ই সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে দুর্গাপূজার প্রেক্ষাপটের সাথে সম্পর্কবিহীন বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপিত করে গর্বের সাথে বলা হচ্ছে - এবার আমাদের থিমপূজা হচ্ছে। এই থিম আগে স্থান পেতো মন্ডপের বাইরে, বিশেষত আলোকসজ্জায়। এখন মূল মন্ডপ এমনকি দুর্গামূর্তিও এই থিমের কবলে। আমরাও দেখতে যাচ্ছি, নতুন জামাকাপড় পরে, রাত জেগে!

থিমপূজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল বার্তাটা আমরা ধরতে পারছি না। সেটা হল - ধীরে ধীরে দুর্গাপূজার ধর্মীয় আঙ্গিককে গুরুত্বহীন করা হচ্ছে, বাঙালিকে ধর্মহীন করা হচ্ছে। দুর্গাপূজা থেকে দুর্গাপূজা বিহীন থিমপূজার একটা ট্রানজিটে আমরা অবস্থান করছি। এরপর হয়তো খালি প্রতীক হিসেবে ঘটপূজা হবে, মন্ডপসজ্জা এবং মূর্তিতে থিমের মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে 'ধর্ম যার যার, উৎসব সবার' গোছের কিছু সুচিন্তিত ন্যারেটিভ। তারপরের ধাপে শুধুই থিম, পূজা বাদ। প্রতিমা নিরঞ্জন উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা নয়, হবে কার্নিভাল, পাশ্চাত্যের অনুকরণে বড় বড় ছাতা থাকবে, ট্যাবলো থাকবে, থাকবে চোখ ধাঁধানো বিভিন্ন উপকরণ। মা দুর্গার প্রতিমা থাকবে না সেখানে। আগেই চুপেচাপে ঘট বিসর্জন হয়ে যাবে সবার অলক্ষ্যে! আমরা ধন্য হবো - আহা কী দেখিলাম, জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিবো না!

দিন আসছে, হয়তো বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকবে অন্নপ্রাসনের থিম, আর অন্নপ্রাসনের অনুষ্ঠানে শ্রাদ্ধের থিম। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা দুহাত তুলে বলবে, সাধু সাধু! কী ব্যতিক্রমী প্রয়াস! হোয়াট বেঙ্গল থিংক্স টুডে, ইন্ডিয়া থিংক্স টুমরো!

আজকে গোটা দুনিয়ার বুঝতে পারছে, আমরা, বাঙালিরা যা করে চলেছি তা উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় নয়, এটা একটা দেউলিয়া মানসিকতা, চূড়ান্ত অগভীর চিন্তাশক্তির প্রতিফলন।

বাঙালি তো বুদ্ধিবৃত্তিতে এরকম দীনহীন কখন‌ও ছিল না!!

দরকার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি

আমাদের কোনও কিছুকে আংশিক ভাবে দেখার পরিবর্তে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ব্যক্তি হোক, বস্তু হোক, ঘটনা হোক অথবা পরিস্থিতি হোক অথবা মতাদর্শ হোক; সার্বিকভাবে তার প্রভাব (impact), পরিনাম (consequences) অথবা উপযোগিতা (utility) বিচার করে তার গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারিত হ‌ওয়া দরকার।

মনে করুন একটা পিল, যাতে একটু পটাশিয়াম সায়ানাইড যার উপরে সুগার কোটিং দেওয়া আছে। কেউ বলবে ওটা মিষ্টি, কেউ বলবে ওটা বিষ। দুটোই সত্য। বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু ওটা খেলে তার পরিনাম কী হবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মানুষ সার্বিক পরিনামের কথা ভেবেই স্থির করবে ওই পিল খাবে কি খাবে না। যে মরতে চায় সে খাবে, আর যে বেঁচে থাকতে চায় সে খাবে না। কিন্তু যারা বক্তব্যের সত্যাসত্য নিয়ে শুধু লম্বা বিতর্ক‌ই করতে থাকবে, তাদের এই বিতর্কের মূল্য কি? তারা একবার বলবে পিলটা খুব মিষ্টি, আবার পরক্ষণেই বলবে পিলটা খুব বিষাক্ত। দুটোই সত্য হলেও এদের এই বিতর্ক কাউকে পথ দেখাবে না, শুধু বিভ্রান্ত‌ই করতে থাকবে। আপনাকে সার্বিক পরিনতির কথা ভেবেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কি করবেন।

একটা মতাদর্শের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। কতটা ঠিক, কতটা ভুল সেটা বিচার্য্য নয়। বিচার্য্য বিষয় হল এই মতাদর্শের সার্বিক পরিনাম দেশ ও জাতির উপরে কি হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলছি, গান্ধীর আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস, গোরক্ষায় আগ্রহ, অনারম্বর জীবনযাপন, রামরাজ্যের কল্পনা ইত্যাদি (সেগুলো ভন্ডামি না সত্য সে বিচারে যাচ্ছি না) দেখে আপনি তার প্রশংসা করতেই পারেন। পাশাপাশি ইসলামের বিষয়ে তার চূড়ান্ত সমঝোতার নীতি, অনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ইত্যাদি দেখে আপনি তার সমালোচনাও করতে পারেন। কিন্তু সার্বিক বিচারে আপনাকে স্থির করতে হবে, গান্ধীর নেতৃত্বে দেশ ও সমাজ নিরাপদ  ছিল কি না। হয়তো গান্ধীর অনেক কিছুই অনেকের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় থাকতে পারে। কিন্তু আজ প্রমাণিত যে টোটাল 'গান্ধী প্যাকেজ' দেশের এবং হিন্দুদের যে সর্বনাশ করেছে তা অপূরণীয়। 

আজও অনেকেই অনেক ন্যারেটিভ সামনে আনছেন বা এনেছেন। তার কতটা গ্রহণযোগ্য, কতটা নয় - এর পারসেন্টেজের হিসাব করে সেই ন্যারেটিভকে অনুসরণ করার পরিবর্তে দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নির্মাণে এদের টোটাল প্যাকেজের (ন্যারেটিভ, কার্যপদ্ধতি, নেতৃত্ব, কমিটমেন্ট ইত্যাদি) সার্বিক প্রভাব ও উপযোগিতা কতটা, সেটা ভেবেই সেই প্যাকেজের মূল্যায়ন করা উচিত। মূল্যায়ন করুন, সিদ্ধান্ত নিন, নিজেকে নিয়োজিত করুন। এদিক ওদিক হাতড়ে বেরিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। সময় আমাদের হাতে খুবই কম।

দুর্গাপূজা এখন শারদোৎসব

প্রথমে হলো দুর্গাপূজা থেকে দুর্গোৎসব। তাতে খুব একটা অসুবিধা নেই। কারণ বাঙালির উৎসব আর পূজাকে আলাদা করা যায় না। প্রায় সব উৎসবেই পূজার ছোঁয়া লেগে থাকে। দোল, মকর সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষ - সবেতেই পূজার একটা অংশ আছে।

কিন্তু এরপর দুর্গোৎসব হয়ে গেল শারদোৎসব। পূজা বাদ হয়ে যাওয়ার পরে দুর্গাও বাদ। পড়ে র‌ইলো শুধু উৎসব, যেটা শরৎকালে হয় বলে শারদোৎসব।

এরপরে এলো নতুন ন্যারেটিভ - ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। প্রতিমা নিরঞ্জন বাদ গেল, এলো কার্নিভাল। পূজা উদ্বোধনে রাজনৈতিক নেতা নেত্রীর ভীড়। সেখানেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। বিধায়ক সেনবাবুর সাথে পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য জনাব হায়দার আলীকে থাকতেই হবে! লেটেস্ট ট্রেন্ড হল হিন্দু মহিলা নেত্রীর হিজাব পরে পূজা উদ্বোধন! মূর্তিমতি সেকুলারিজম(অবশ্য সেকুলারিজম কোন লিঙ্গের তা জানা নেই)!

এখন চলছে থিমের বোলবালা। অস্ত্রহীনা দুর্গামূর্তি! আজান মুখরিত মন্ডপ! বাঙালির দূর্গাপূজা থেকে আজান মুখরিত মন্ডপের এই যাত্রা আসলে একটা দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন। এই পরিকল্পনা হল ধীরে ধীরে বাঙালিকে তার চিরন্তন শক্তির উপাসনা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। এর সাথে বাঙালিয়ানার মধ্যে আরবের মরু সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় কেড়ে নিয়ে এই জাতিকে একটা আত্মপরিচয়বিহীন জনতার ভীড়ে রূপান্তরিত করার ষড়যন্ত্রের শিকড় আজ অনেক গভীরে পৌঁছে গিয়েছে। পচন শুরু হয়েছে মাথা থেকেই। এই যাত্রাপথ শেষ হচ্ছে বাঙালির সম্পূর্ণ ইসলামীকরণে। এই যাত্রা আসলেই বাঙালির অন্তর্জলি যাত্রা। এই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাঙালি জাতিকে স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর দায়িত্ব আজকের বাঙালি যুবসমাজকেই নিতে হবে।

গান্ধী একটা প্যাকেজ, বিষের থলি

'গান্ধী' একটা কমপ্লিট প্যাকেজ(বিষের থলি), আপোষ মীমাংসার জন্য জাতির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়ার নীতিই যার মূল। এই প্যাকেজের 'এই অংশটা ভালো' কিংবা 'ওই অংশটা খারাপ' এটা হয়না। তবুও হঠাৎ 'গান্ধী' কে গ্লোরিফাই করার একটা ট্রেন্ড নতুন করে শুরু হয়েছে। এর পরিণতি ভয়ংকর হবে। হিন্দুকে বাঁচতে হলে 'গান্ধীত্ব(😊)'-র  ঠিক বিপরীত পথে হাটতে হবে।

'গান্ধীর পথে চললে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হতে পারে' - খবরের কাগজে হেডলাইন। বক্তা নাকি আমাদের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদি সত্যি হয় তাহলে তাঁকে অনুরোধ করবো, জাতিকে নতুন করে বিভ্রান্ত করবেন না। 'গান্ধীর পথ'-এর পরিণাম দেশভাগ, হিন্দুদের গণহত্যা, হিন্দু নারীদের গণধর্ষণ, আমাদের উদ্বাস্তু হ‌ওয়া। এই পথের ফলশ্রুতি হল জাতীয় বিপর্যয়। আমরা এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাই না।

যে মুখে রামধুন, সেই মুখেই অন্যায়ের সাথে আপোষ করার পরামর্শ - এই ভন্ডামিকে গ্লোরিফাই করলে গোটা জাতিটাই ভন্ড(যেটুকু বাকি আছে) হয়ে যাবে। মোদিজীকে অনুরোধ, এই উপকারটুকু করবেন না। গান্ধী আজ অপ্রাসঙ্গিক। ওকে নতুন করে প্রাসঙ্গিক করে তুলবেন না।

নবরাত্রি পালন, মহিষাসুর মর্দিনী মা দু্র্গার উপাসনা আর গান্ধীভজনা একসাথে চলতে পারে না। এদুটো পরস্পরবিরোধী। যারা এটা করবেন, তাদের চেয়ে বড় ভন্ড এই দুনিয়ায় আর নেই।