Wednesday, September 11, 2019

ওরা পারে, কিন্তু আমরা পারি না

যৌক্তিকতা অথবা ঔচিত্যের প্রশ্নটা আলাদা। প্রশ্নটা হচ্ছে ওরা অস্ত্র মিছিল করছে, প্রশাসন নীরব। আমরা করলে প্রশাসন সক্রিয়। ওরা প্রতি সপ্তাহে রাস্তা বন্ধ করে নামাজ পড়ছে, আমরা বছরে এক দুবার রাস্তায় পূজোপাঠ করলে প্রশাসন বিভিন্ন ফরমান জারি করছে। ওরা মসজিদে দিনে পাঁচবার মাইক বাজাচ্ছে, আমরা বাজাতে চাইলে অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। আইনের শাসন শুধুমাত্র আমাদের উপরে, ওদের জন্য কনসেশন। আসলে কনসেশন নয়, এটা কম্প্রোমাইজ। সবক্ষেত্রে চূড়ান্ত কম্প্রোমাইজ। মাদানী সাহেব আসামে দাঙ্গা করার হুমকি দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকেন, দেবতনু ভট্টাচার্য আত্মরক্ষার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিতে আহ্বান করলে তার বিরুদ্ধে ১৫৩-র এ ধারায় ২৭টি মামলা হয়। ওরা পাকিস্তানের পতাকা তুলতে পারে, জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন সিটে বসে থেকে জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করতে পারে, সোস্যাল মিডিয়ায় হিন্দু দেবদেবীর অপমান করতে পারে, দেশের আইন না মানার ঘোষণা প্রকাশ্যে করতে পারে। অন্যায় হলেও পারে। এদিকে আমরা নিজেদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে বলে ক্ষীণ স্বরে চিৎকার করতে পারি, কিন্তু অধিকার আদায় করে নিতে পারি না। ওরা অন্যায় করছে বলে কিছুটা ভয়ে ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে তার প্রতিবাদ করতে পারি কিন্তু শেষমেশ ওদের থামাতে পারি না।

ওরা যেটা চায়, সেটা ন্যায়সঙ্গত না হলেও ওরা করতে পারে। আমরা ন্যায্য অধিকারও আদায় করতে পারি না। কেন?

প্রথমত, আমাদের মধ্যে আমাদের 'সামাজিক পরিচয়'-এর বোধ নেই। সমাজ হিসেবে 'আমরা' কারা? সমাজ হিসেবে আমাদের ইতিহাস কি? সমাজ হিসেবে আমাদের জয় এবং পরাজয়ের ঘটনাগুলো কি? সমাজ হিসেবে আমাদের সুখ ও দুঃখের ঘটনাগুলো কি? কোন্ কোন্ ঘটনায় সমাজ হিসেবে আমাদের লাভ হয়েছে? আবার কোন্ কোন্ ঘটনায় সমাজ হিসেবে আমাদের ক্ষতি হয়েছে? সমাজ হিসেবে আমাদের চোখে হিরো কে আর ভিলেন‌ই বা কে? শত্রু কে? মিত্র‌ই বা কে? গৌরবের চিহ্ন কোনগুলো? অপমানের চিহ্ন‌ই বা কোনগুলো? আমাদের কিসে ভালো আর কিসে খারাপ - এই সমস্ত বিষয়ে সমাজ হিসেবে আমাদের 'সামাজিক ঐক্যমত' আছে? নেই। থাকলে বাঙালি হিন্দুদের এই করুণ অবস্থা হতো না। কিন্তু এই 'সামাজিক ঐক্যমত' ওদের আছে। তাই ওরা পারে, আমরা পারি না।

দ্বিতীয়ত, সমাজবোধ না থাকলে একটা সমাজের জনসংখ্যা থাকতে পারে কিন্তু জনবল থাকে না। জনবল না থাকলে শেষ পর্যন্ত জনসংখ্যাটাও ধরে রাখা যায় না, অবক্ষয় হতে হতে একদিন বিনাশ হয়। সমাজবোধ হল সমাজের প্রাণ। সমাজবোধ না থাকায় বাঙালি হিন্দু আজকে প্রায় প্রাণহীন শরীরে পরিণত হয়েছে। আমাদের জনসংখ্যা আছে, জনবল নেই। ওদের জনসংখ্যাটাই জনবল, যেটা ক্রমাগত বাড়ছে। তাই ওরা পারে, আমরা পারি না।

তৃতীয়ত, নিজের সমাজের উত্থানের জন্য, অধিকার আদায় করে নেওয়ার জন্য মূল্য দিতে হয়, সমর্পণ করতে হয়। সময় দিতে হয়, অর্থ দিতে হয়, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিদ্যা, বুদ্ধি - সব ঢেলে দিতে হয়,  প্রয়োজনে রক্ত‌ও দিতে হয়। আমরা কি প্রস্তুত? ওরা জাকাত দেয়, ওরা জেহাদের টানে আত্মাহুতি দেয়, কেস খায়, জেল খাটে। তাই ওরা পারে, আমরা পারি না।

চতুর্থত, সমাজের 'Collective will' যাতে সমাজ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয় তার জন্য সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঠিক পরিচালনার জন্য পরিচালন সমিতিতে, মন্দির কমিটি, হাট/ বাজার কমিটি, পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে লোকসভা পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রে সঠিক প্রতিনিধিত্ব পাঠানোর জন্য ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। 'রাজনীতি পছন্দ করি না' গোছের ন্যাকামো করলে চলবে না। এটা সামাজিক দায়িত্ব। জনপ্রতিনিধিরা তার কাজ সঠিকভাবে না করলে সামাজিক আন্দোলন করতে হবে, রাস্তায় নামতে হবে। আমাদের কালেক্টিভ উইল ভোটে প্রতিফলিত হয় না, ওদের ভোটে তো হয়‌ই, অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রেও হয়। তাই ওরা পারে, আমরা পারি না।

সর্বোপরি সমাজকে ঠিক রাখার দায়িত্ব মহাপুরুষদের নয়, সাধারণ মানুষের। যাঁরা ব্যক্তিগত কাজের ব্যস্ততার মধ্য থেকে সময় বার করে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা মহান নন, তাঁরাই সাধারণ। একটা সমাজ তার সাধারণ সদস্যদের কাছেই এই দায়িত্ববোধ আশা করে। মহান ব্যক্তিত্বরা একটা সমাজের উপরি পাওনা।কিন্তু যারা এই দায়িত্ব এড়িয়ে যান, তারা সাধারণ নন, তারা Below Normal Standard. 'সবাই তো আর মহাপুরুষ হতে পারে না' - এ বড় চালাকির কথা! এই কথা বলে আমাদের সমাজের অধিকাংশ সদস্য তাদের সামাজিক দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। এই চালাকি চলবে না। আমাদের বাঙালি হিন্দু সমাজের মাথায় পচন ধরেছে। আমরা আমাদের নিজেদের সমাজকেই ঠকাই, ওরা নিজেদের সমাজকে ঠকায় না। তাই ওরা পারে, আমরা পারি না।

No comments:

Post a Comment