Tuesday, November 26, 2019

হিন্দু ভোট যত কনসলিডেট হবে, হিন্দু তোষণের প্রতিযোগিতা তত বাড়বে

যেদিন রামমন্দির ইস্যু প্রথমবার সকলের সামনে এসেছিলো, সেই দিনটাতেই বোধহয় ভারতের রাজনীতির হিন্দুকরণের সূত্রপাত হয়েছিল বলে ধরা যায়। হিন্দুদের কোনও দাবি নিয়ে যে রাজনীতি হতে পারে, এর আগে এটা অবাস্তব বলে মনে হত সবার। কিন্তু ভারতের রাজনীতিকে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত করে দিল এই ইস্যু। ভারতের রাজনীতিতে আগে ছিল শুধুই মুসলিম পক্ষ। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের পাখির চোখ ছিল মুসলিম ভোট। রামজন্মভূমি আন্দোলন থেকে শুরু হল হিন্দুর রাজনৈতিক কনসলিডেশন। হিন্দুরা এবার একটা পক্ষ হল। তাদের একটা আত্মবিশ্বাস জন্মালো - যে হিন্দুরা বাবরি মসজিদকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে, তাদের অসাধ্য আর কী থাকতে পারে! এই আত্মবিশ্বাস থেকেই তৈরি হল হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক আর এই ভোটব্যাঙ্ককে পাখির চোখ করল বিজেপি। বিজেপির উত্থান এই হিন্দু ভোটের উপরে ভিত্তি করেই। রামজন্মভূমি আন্দোলন‌ই বিজেপিকে ভারতের রাজনীতিতে এসকেপ্ ভেলসিটির ইন্ধন যোগালো।

যদিও ভারতের রাজনীতির গতি প্রকৃতি আগেও হিন্দুরাই নির্ধারণ করতো, কিন্তু এই বোধ হিন্দুদের এর আগে ছিল না। একটা মিথ্যা ন্যারেটিভ সুন্দর ভাবে পরিবেশন করা হত - মুসলিম ব্লকভোট‌ই ভারতের রাজনীতির ভাগ্যনিয়ন্তা। আর এই মিথ্যাকে ছন্নছাড়া হিন্দুরা বিশ্বাস করতো মনেপ্রাণে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতৃত্বের অধিকাংশ এখনও এই বিশ্বাস নিয়েই রাজনীতি করে যে মুসলিম ভোট না পেলে এরাজ্যে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়। তাদের এই ধারণার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। 

বিশ্ববাসীর ভুল ভাঙলো ২০১৪ সালের সেই দিনটাতে, যেদিন গুজরাটের গোধরায় হিন্দু হত্যার দৃষ্টান্তমূলক প্রতিশোধের নায়করূপে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হলেন। এই জয় বাস্তবে বিজেপির জয় ছিল না, এই জয় ছিল দীর্ঘদিনের পরাজয়ের গ্লানি বুকে চেপে রাখা, নিজের দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের ব্যবহার পেয় লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে থাকা হিন্দুদের বহু আকাঙ্খিত জয়। হিন্দুরা মোদিজীর অভিষেক চেয়েছিল, তাই মোদিজী সিংহাসনে বসেছিলেন। তাই আমরা দেখলাম উন্নয়নের জোয়ার ব‌ইয়ে দেওয়া স্বপ্নের নায়ক উদারচতা বাজপেয়ীজীর ফিলগুডের সরকার পরাজিত হলেও ২০১৪-তে ব্যাপক জনসমর্থন পেলো মুসলমানের রক্তে হোলি খেলার তকমাধারী নরেন্দ্র মোদির সরকার। 

২০১৪ র নির্বাচনের ফলাফল হিন্দুদের আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল এবং মোদিজীও এই পাল্স বুঝে নিয়েছিলেন সঠিকভাবেই। তাই পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, তিন তালাক নিষেধ, বারাণসীর তীরে গঙ্গারতি, সৌদি আরবে মন্দির নির্মাণ, নাগরিকত্ব বিল লোকসভায় পাশ করানো মোদি সরকার ২০১৯-এ হল আরও অনেক বেশি শক্তিশালী। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি এই সরকারকে। নিয়ে চলেছে একের পর এক কঠোর এবং সাহসী সিদ্ধান্ত - ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, রামমন্দির তৈরির পথ প্রশস্ত করার পথ ধরে আবার আসছে নাগরিকত্ব বিল এবং তারপরে এন‌আরসি। দ্বর্থ্যহীন ভাষায় সরকারের সাহসী ঘোষণা - বহিরাগত হিন্দুরা শরণার্থী আর মুসলমানরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী! দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র হতে আর বাকি র‌ইলো কী!

সরকারের এই সিদ্ধান্তগুলো হিন্দুদের প্রতি ন্যায় বিচার তো অবশ্যই, কিন্তু যদি রাজনীতির পরিভাষায় কেউ একে 'হিন্দু তোষণ' বলে, সে কি বিরাট ভুল করে ফেলবে? কেউ যদি বলে বিজেপির এই 'হিন্দু তোষণ' বিরোধী দলগুলোর মুসলিম তোষণের পাল্টা রাজনৈতিক চাল, সেও কি খুব ভুল বলবে? দেশের ৮০% ভোটারকে কনফিডেন্সে নিয়ে রাজনীতি করাটাই তো স্বাভাবিক। তবে এটা এতদিন কোনও পার্টি করেনি কেন? কারণ এতদিন হিন্দুরা তাদের ভোটের মূল্য এবং ক্ষমতা বোঝে নি। মুসলমানরা বরাবর মুসলমান হিসেবে ভোট দিয়েছে, হিন্দুরা ভোট দিয়েছে নিজের নিজের পছন্দের পার্টির একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে। সেকুলার ভারতে হিন্দু হিসেবে ভোট দেওয়া যায়, এবং সেই ভোটে সরকার গড়া যায় একথা বাবরি ধ্বংসের আগে হিন্দুরা কোনদিন ভাবতেই পারেনি। সেই ঘটনার পরে কিন্তু হিন্দুদের মনে নিজেদের দেশ নিজেরা শাসন করার একটা আকাঙ্খার জন্ম নিয়েছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। তাই এই 'হিন্দু তোষণ' অথবা হিন্দুত্ব কেন্দ্রিক রাজনীতি বর্তমান সেকুলার ভারতে সম্ভব হয়েছে কোনও রাজনৈতিক দল অথবা নেতার বদান্যতায় নয়, এটা সম্ভব হয়েছে হিন্দু তার শক্তি সম্পর্কে অবহিত হয়েছে বলে, বিশেষতঃ সে তার ভোটের মূল্য এবং ক্ষমতা - দুটোই বুঝতে পেরেছে বলে।

একদিকে হিন্দু তার ভোটের মূল্য বুঝতে পেরেছে। অপরদিকে মোদি-শাহ'র বিজেপিও হিন্দুদের ভোটের মূল্য কিছুটা হলেও দিয়েছে। প্রতিদানে হিন্দুরাও তাদের বিমুখ করে নি। পরিণামে আজ হিন্দু ব্লকভোট‌ আর বিজেপির সাপোর্ট বেস সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলস্বরূপ কোনঠাসা হয়েছে সেকুলারিজমের নামে মুসলিম তোষণকারী প্রত্যেকটা দল। চাপে পড়ে এখন অনেকের মাথা থেকে ফেজটুপি সরে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে নীলসাদা হিজাব। সম্প্রতি আমাদের রাজ্যে উদ্বাস্তুদের জন্য জমির পাট্টা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। খুব সম্ভব রাজ্য সরকারের দৃষ্টিতে হিন্দুরাই উদ্বাস্তু। যদি তা ই হয়, তাহলে কি এবার এই রাজ্যেও 'হিন্দু তোষণ' পর্ব শুরু হতে চলেছে? অসম্ভব কিছু নয়।

১৫-২০% বাম ভোটের সাথে গোটা ১৫% মুসলিম ভোট তৃণমূলের থেকে বেরিয়ে গিয়ে জোট বাঁধার যে ভয় দেখিয়ে রাজ্যের মুসলমানরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্ল্যাকমেল করছিল, বামেদের ভোট কমে গিয়ে ৭% এ ঠেকায় এখন সেটা আর করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং মমতা ব্যানার্জির মুসলিম তোষণের কম্পালশন আর বিশেষ নেই। তাই এখন ওয়েসি-র মিম পার্টিকে এনে তৃণমূলের মুসলিম ভোট কাটার ভয় দেখিয়ে মমতাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে মুসলমানেরা। কিন্তু মুসলমানরা কি তৃণমূলের ভোট কেটে বিজেপির সুবিধা করে দিতে চাইবে? তারা এটা করবে বলে আমার মনে হয় না। তাহলে নিজেদের বাঁচার তাগিদে তৃণমূলকে বাঁচিয়ে রাখার কম্পালশন এখন কাদের? মমতা ব্যানার্জি এখন মুসলমানদের কেবল বিজেপির জুজু দেখিয়েই শান্ত করে রাখবেন। আমি বিশ্বাস করি মমতা ব্যানার্জি যা করেন, নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই করেন।

এদিকে মিমের প্রচারে যে হিন্দু কনসলিডেশন তৈরি হবে, তাকে ভাঙার জন্য মমতা ব্যানার্জিকে হিন্দুর জন্য হাত খুলতেই হবে। ইতিমধ্যেই তার কিছু কিছু ইঙ্গিত‌ও পাওয়া যাচ্ছে। মাথার হিজাব তো নেমে গেছেই, সাথে সাথে পূজার ভোগ রান্না করার ভিডিও বের করা হচ্ছে। উদ্বাস্তুদের জন্য জমির পাট্টা দেওয়ার ঘোষণাও অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। তবে নাগরিকত্ব বিল পাশ হলে মমতার উপরে চাপ আরও বাড়বে। আমার ধারণা তৃণমূল উদ্বাস্তু হিন্দুদের ভোটের কথা মাথায় রেখে এই নাগরিকত্ব বিল পাশ করাতে পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে সহযোগিতাই করবে। 

হিন্দু ভোট যত কনসলিডেট হবে, হিন্দু তোষণের প্রতিযোগিতা তত বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে লাখ টাকার প্রশ্ন থেকেই গেল - রাজ্যের রাজনীতিতে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকা মুসলিম ভোটের লোভে পড়ে রাজ্য বিজেপি নিজেদের পায়ে, সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী হিন্দুর পায়ে কুড়াল মারবে না তো? বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব এই সংগঠিত হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে taken for granted মনে করছে না তো!

No comments:

Post a Comment